করোনা: নিউইয়র্কে লাশ বের হলে বেড খালি হচ্ছে, বাংলাদেশি বাবা-ছেলের করুণ মৃত্যু
নিউইয়র্ক থেকে: রাস্তাঘাট জনমানব শূন্য।নেই কোনো ট্রাফিক, নেই পথচারীদের কোলাহল।বিধস্ত এক ভূতুড়ে শহরে পরিণত হয়েছে নিউইয়র্ক। করোনাভাইরাসের আঘাতে শহরটি যেন রাজ্যহীন রাজার কাছে। সেই রাজ্যের রাজাও আজ ক্লান্ত, নিজেই স্তব্দ। ভাইরাসে শুধু বৃহস্পতিবার ও শুক্রবার দুইদিনে মারা গেছেন ৮৪ জন। নিউইয়র্ক পোস্ট বলছে, করোনায় ১৭ মিনিটে এক জন করে মারা গেছেন শহরে।
নিউইয়র্ক যেন ধীরে ধীরে মৃত্যুপুরী হয়ে উঠেছে। হাসপালাগুলোতে ঠাই নেই। এলমহার্স্ট হাসপাতালে ফ্রিজার ট্রাক সংযুক্ত করে রাখা হয়েছে। লাশ বের হলে বেড খালি হচ্ছে। অ্যাম্বুলেন্স ভীতিকর সাইরেন বাজিয়ে নতুন রোগীর আগমন এখন নিয়মিত দৃশ্য।
নিউইয়র্ক শহরের মেয়র ও গভর্নর এন্ড্রু ক্যুমো নিউইয়র্কের জন্য আরও বেশি ফেডারেল সাহায্যের জন্য জোর দাবি জানাছেন।
ম্যানহাটনের জ্যাকব জ্যাভিট সেন্টারে মার্কিন সেনা সদস্যরা দ্রুত ১০০০ বেডের হাসপাতাল নির্মাণ করতে হিমশিম খাচ্ছেন। পেন্টাগন থেকে বলা হয়েছে, এমন মহামারীতে হাসপাতাল নির্মাণের অভিজ্ঞতাও তাদের নেই। ১০ ফিট বাই ১০ ফুট কোঠরি করে পর্দা ঝুলিয়ে ১০০০ বেডের হাসপাতাল নির্মাণ হচ্ছে, কাজ চলছে দিনরাত। এ হাসপাতালে নিউইয়র্ক নগরীর করোনা ভাইরাস নয় এমন রোগীদের চিকিৎসা দেয়া হবে। অন্যান্য হাসপাতালে করোনাভাইরাস আক্রান্তের জন্য জায়গা খালি করার জন্য এ হাসপাতালকে ব্যবহার করা হবে। এ ছাড়া নগরীর আরো তিনটি স্থানে হোটেল ও নার্সিং হোমকে অস্থায়ী হাসপাতালে রূপান্তরিত করে করোনা প্রলয় মোকাবিলা করা প্রস্তুতি চলছে।
নিউইয়র্ক শহরের মেয়র ডি ব্লাজিও অভিযোগ করেছেন, বেশ কিছু ধর্মগোস্টি প্রার্থনার জন্য সমাবেশ করতে গিয়ে সামাজিক দূরত্ব রক্ষার নির্দেশনা মানছে না। মেয়র বলেছেন, নির্দেশ অমান্যকারীদের ৫০০ ডলার করে জরিমানা করা হবে।
মেয়র নিউইয়র্কের নাজুক পরিস্থিতি মে মাস পর্যন্ত গড়াবে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।
করোনার এই ভয়াল থাবায় প্রাণ হারিয়েছেন অনেক বাংলাদেশি। শুক্রবার দু’জন বাংলাদেশি করোনাভাইরাসে মারা যান। সেই শোক কাটতে না কাটতে কমিউনিটিতে নেমে এসেছে আরেকটি দুঃসংবাদ। ছেলের মৃত্যুর দুইদিন পর বাবার প্রাণ গেল একই হাসপাতালে।
জানা যায়, শুক্রবার সাফি উদ্দিন বেপারী(৫৭) নামের একজন বাংলাদেশির কুইন্সের এলমহার্স্ট হাসপাতালে মৃত্যু হয়। এর দুইদিন আগে সাফি উদ্দিনের ছেলে শাকিল সালেহ কিডনিজনিত রোগে মারা যান। যদিও সাফি উদ্দিন বেপারী কি রোগে মারা গেছেন সেটা নিশ্চিত করা যায়নি।এরপর সাফি উদ্দিন বেপারীর স্ত্রী ও ছেলের বউ হাসপাতালে ভর্তি হন। তবে তাদের করোনাভাইরাস নেগেটিভ ধরা পড়ে। বাংলাদেশ সোসাইটির সাধারণ সম্পাদক রুহুল আমিন আওয়াজবিডিকে এই তথ্য নিশ্চিত করেন। এদিকে জ্যামাইকায় প্রবাসী বাংলাদেশি আব্দুর রাজ্জাক জ্বরে আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন। আব্দুর রাজ্জাকের গ্রামের বাড়ি রংপুরের চিলমারীতে। তিনি চিলামারী হাইস্কুলের শিক্ষক ছিলেন।
করোনায় আক্রান্ত হয়ে নিউইয়র্কের বাংলাদেশি কমিউনিটির বেশ কিছু পরিচিত লোকজন অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে আছেন। এর মধ্যে একাধিক চিকিৎসক, সাংবাদ মাধ্যমের লোক, পুলিশ এবং ব্যবসায়ী রয়েছেন। নিউইয়র্ক পুলিশের অনেকের শরীরে ভাইরাসের সংক্রমণ পাওয়ায় ভীতিকর অবস্থার সৃষ্টি করেছে। এর মধ্যে দু’জন পুলিশ করোনায় মারা গেছেন।
এদিকে করোনাভাইরাসের তাণ্ডবে নাকাল আমেরিকার নাগরিকদের দ্বিতীয় দফা নগদ সাহায্যের উদ্যোগ নেয়া হচ্ছে। চলমান সভ্যতার সবচেয়ে বড় মানবিক সংকটে দাঁড়িয়ে প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ইতিহাসের বৃহত্তম নাগরিক সহযোগিতা বিলে সাক্ষর করছেন। দুই থেকে তিন সপ্তাহের মধ্যে নাগরিকরা তাদের ব্যাংক একাউন্টে বা ডাকযোগে সহযোগিতার অর্থ পাবেন। স্পীকার ন্যান্সি পলেসি বলেছেন , নাগরিকদের সহযোগিতার জন্য দ্বিতীয় দফা একটি আইন প্রস্তাব নিয়ে তারা এরমধ্যেই কাজ শুরু করছেন। যদিও স্পীকার ন্যান্সি পলেসিকে বিল সাক্ষরের অনুষ্ঠানিকতায় হোয়াইট হাউস থেকে আমন্ত্রণ জানানো হয়নি।
একাধিক মার্কিন সংবাদ মাধ্যমে বলা হয়েছে, দেশের চরম সংকটের মুহূর্তেও প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প এবং ডেমোক্রেট দলের নেতা স্পীকার ন্যান্সি পলেসি ১৬ মার্চের পর সরাসরি কোন কথাই বলেননি। পরিস্থিতি মোকাবিলায় প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প এর মধ্যেই দেরি করে ফেলেছেন এবং এখনও তিনি নিউইয়র্কের মতো নাজুক শহরের জন্য পর্যাপ্ত সাহায্য নিয়ে এগিয়ে আসছেন না বলে ক্ষোভ প্রকাশ করা হচ্ছে।
নানা দর কষাকষির পর ২৭ মার্চ শুক্রবার বিকেলে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প করোনাভাইরাস রিলিফ প্যাকেজ আইন অনুমোদন করেছেন। আইনে স্বাক্ষর করে ট্রাম্প বলেছেন , অদৃশ্য শত্রুর আঘাতে আমরা জর্জরিত। তিনি আশা করেন, করোনা রিলিফের এ আইনের ফলে আমেরিকার অর্থনীতি চমৎকারভাবে ঘুরে দাঁড়াবে। এ আইনে কর্মহীন নাগরিকরা সপ্তাহে ৬০০ ডলার পর্যন্ত টানা চারমাস বেকার ভাতা পাবেন। ১০১৮ সালের বা ২০১৯ সালের ট্যাক্স রিটার্নের সূত্র ধরে যাদের ডিরেক্ট ডিপোজিট করা আছে , তাদের ব্যাংক একাউন্টে যাবে, অন্যদের ডাকযোগে যাবে। তিন সপ্তাহের মধ্যে না পেলে আইআরএস নির্দিষ্ট ফোন নাম্বার দেবে ফোনকল করার জন্য।
সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী যুক্তরাষ্ট্রে ১ লাখ ৪ হাজারেরও বেশি মানুষ করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন এবং মারা গেছেন ১৭০৪ জন৷ নিউইয়র্কে করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন ৪৬২৬২ জন এবং মারা গেছেন ৬০৬ জন৷