রুপপুরের নির্বাহী প্রকৌশলী বালিশ মাসুদের খোলা চিঠি!
আমার নাম এখন দেশের বিদেশের প্রায় সব বাঙ্গালিই জেনে গেছেন। জি, হ্যাঁ আমি সেই নির্বাহী প্রকৌশলী রুপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের মাসুদুল আলম। যাকে এখন ব্যঙ্গ করে আপনারা ‘বালিশ মাসুদুল আলম’ বলে সম্বোধন করেন। আমি আমার সমস্ত দোষ স্বীকার করে নিয়ে আপনাদের কাছে কিছু কথা বলতে চাই।
শৈশবে আমার কেরানি বাবা আমার জন্য ৪/৫টা গৃহ শিক্ষক রেখে লেখা পড়া শিখিয়েছিলেন। আমাকে তিনি ডাক্তার বা ইঞ্জিনিয়ার বানাতে চেয়েছিলেন, আমি অবশেষে ইঞ্জিনিয়ার হয়েছি। আসলে আমার কোন শৈশব ছিল না।
আমি কারো সাথে মিশিনি, কারো বন্ধু ছিলাম না, এমন কী ক্লাসে ফার্স্ট হবার জন্য বাবা-মায়ের কথামত ক্লাসের বন্ধুদেরও কখনো লেখা পড়ায় কোন সাহায্য করিনি এই জন্যে যে, তারা যদি আমার চেয়ে ভালো রেজাল্ট করে ফেলে! তাই আমার মধ্যে কোন মানবিক গুনাবলীর উন্নয়ন ঘটেনি শুধু ভালো ছাত্র হওয়া ছাড়া।
আমি যখন যা চেয়েছি, কেরানি বাবা তার চেয়ে আমাকে অনেক বেশি দিয়েছেন। বলেছে তোমার সব চাহিদা আমি পূরণ করবো, তুমি শুধু আমার একটা চাহিদা পূরণ করবে, সেটা হল ভালো রেজাল্ট করে ডাক্তার বা ইঞ্জিনিয়ার হবে, আর অনেক টাকা আয় করবে। তাই আমার ধ্যান জ্ঞান সবই ছিল লেখা পড়াই ভালো করা।
আমি যখন ছোট তখন দেখেছি, প্রায় প্রতিদিন বাবা অফিস থেকে ফিরে মাকে অনেক টাকা দিতেন। আমি ভাবতাম চাকরি করলে মনে হয় প্রতিদিন টাকা পাওয়া যায়। একটু বড় হবার পরে দেখি বাবা প্রায় বিভিন্ন লোকের সঙ্গে টেলিফোনে কথা বলতেন।
মাঝে মাঝে বলতেন তিনি এখনি বাইরে যাচ্ছেন, ২/৩ দিন বাসায় আসবেন না। তার পরেও দেখতাম তিনি বাসায়। আবার কেউ নিজে এলে কাজের লোক দিয়ে বলতেন, ‘বল আমি ঢাকার বাইরে’। বাসায় বসেই এমন মিথ্যা বলতেন তিনি। কিন্তু কেন?
পরে জেনেছি তিনি কিছু লুকানোর জন্য বা কাউকে এড়িয়ে চলার জন্য মিথ্যা বলতেন। আমি একদিন মাকে বললাম যে, ‘তোমরা সব সময় আমাকে সত্য কথা বলতে বল, কিন্তু বাবা তো মাঝে মাঝে বাসায় থেকেও বলে তিনি বাসায় থাকবেন না, বাইরে আছেন, ইত্যাদি।
এটা কি মিথ্যা কথা না’! মা বলতেন, ‘মাঝে মাঝে এমন ২/১টা মিথ্যা কথা বলার দরকার হয়, বড় হলে বুঝবি’। আমি কনফিউজড হয়ে যেতাম তখন, কিন্তু এখন সব বুঝি।
যখন ইউনিভার্সিটিতে পড়তাম তখন জানলাম আমার বাবা যে বেতন পান তার চেয়ে অনেক বেশি টাকা আমরা প্রতি মাসেই খরচ করি। এমনকি আমার বাবার বেতনের টাকায় আমার পড়ার খরচ ও ঠিক মত হবার কথা না।
বন্ধুরাও আড়ালে আবডালে আমার বাবার আয় নিয়ে টিটকারি মারতো। আমি বুঝতাম, কিন্তু আমার কিছুই করার ছিল না। আমার বন্ধুদের অনেকেই দেখতাম আমার মত পরিবার থেকে এসেছে।
তাদের সাথে আস্তে আস্তে বন্ধুত্ব করে নিলাম, আর প্রতিজ্ঞা করলাম যে, অনেক টাকা আয় করে টাকা দিয়ে ওদের মুখ বন্ধ করবো। কারণ আমরা চাকরি পাবার আগেই পত্র পত্রিকায় সমাজের বিভিন্ন ঘটনায় দেখেছি, টাকা দিয়ে অনেক অন্যায় কাজকে ধামা চাপা দেওয়া যায়। তাই টাকাটাই আমাদের কয়েকজনের কাছে মুখ্য হয়ে গেল।
বাবা বলতেন নীতি ধুয়ে কী পানি খাবি! আমিও তাই বাবার মত করে ভাবতাম। নিতি-নৈতিকতা নিয়ে কখনই কিছু ভাবিনি আমি।
দেখি যে, টাকা দিয়ে বড় দল থেকে যেমন এমপি হবার মনোনয়ন কেনা যায়, টাকা খরচ করে এমপি মন্ত্রী হওয়া যায়, চাকরি পাওয়া যায়, বড় বড় অপরাধ করেও ছাড়া পাওয়া যায়, ইত্যাদি কী না করা যায়। মানে আমাদের সমাজে বলতে গেলে টাকা দিয়ে সব কিছুই করা যায়। তাই আমিও টাকার পিছনে ছুটেছি। মান সম্মানের কথা, ইজ্জতের কথা ভাবিনি।
ঠিকাদারের সাথে যোগসাজস করে তাদের কাজ দিয়েছি। কপি করা জিনিসে ব্র্যান্ডের স্টিকার লাগিয়ে কম দামের জিনিস বেশি দামে কিনেছি কমিশন নিয়ে। চালু আইটেমের দাম কম দেখিয়ে অপ্রচলিত আইটেমের দাম বেশি দেখিয়ে পছন্দের ঠিকাদারকে কাজ দিয়েছি।
কখনো কখনো ঠিকাদারী কাজের প্রথম ফেজে ভালো করে পরের ফেজে আইটেম চেঞ্জ করে কাজের টেণ্ডার ভ্যালুর চেয়ে দাম বাড়িয়ে দিয়েছি কয়েকগুণ। তাতে ঠিকাদার আর আমি দুজনেই লাভবান হয়েছি। ম্যনেজ করেছি উপরের মানুষদের।
বিএনপি সরকার ক্ষমতায় থাকার সময় আচার আচরণে এমন ভাব করেছি যে আমি জিয়ার ক্রিতদাস। আবার শেখ হাসিনা ক্ষমতায় আসার সাথে সাথেই তাড়াতাড়ি চরম বঙ্গবন্ধু প্রেমিক হয়ে গেছি আমরা সবাই দল বেঁধে।
বিভিন্ন রাজনৈতিক অনুষ্ঠানের আয়োজনে গোপনে এতো টাকার আয়োজন করে দিয়েছি যে আওয়ামী লীগ নেতারা ভাবতে শুরু করেছেন যে আমরা তাদেরই লোক। গ্রাম, ইউনিয়ন, উপজেলা, জেলা আওয়ামী লীগ, যুবলীগ, ছাত্রলীগ ইত্যাদি সব কমিটিতে নিজেদের আত্মীয় স্বজন ঢুকিয়ে এমন অবস্থা করেছি যে, সবাই ভাবেন আমরা খাটি বঙ্গবন্ধু প্রেমিক।
নতুন কমিটি করতে নির্বাচন করুক আর যাই করুক আমার লোক ইউনিয়ন, উপজেলা, জেলা কমিটিতে থাকবেই, থাকবে। এটা শিখেছি বিএনপি সরকারের আমলে। সে সময়েও এমন করেছিলাম খাঁটি জিয়া প্রেমিক সাঁজতে। ইদানিং আমাদের সাথীদের সরকারী অফিসে গিয়ে আপনাদের মনে হতে পারে যে এটা আওয়ামী লীগের একটা বড় নেতার অফিস, আমরা কিন্তু আসলে তা না।
বিএনপি আমলে র্যাব যেমন বহু জাতীয়তাবাদী নেতাকে ক্রসফায়ারে মেরেছে, ইদানিং শেখ হাসিনার সরকার দুদুক আর ক্রসফায়ার সমানে চালাচ্ছে। আমরা দল বেঁধে মানবাধিকার সংগঠনকে গোপনে টাকার ব্যবস্থা করে দিয়ে ক্রসফায়ারের হাত থেকে বেঁচেছি কিন্তু দুদুক পিছু ছাড়ে না।
সরকারকে চাপ দিয়ে নিজেদের অনুকূলে আইন করেছি অনেক কিন্তু তাও কাজ হয় না। তাই বউ আর বাবা মায়ের অনুমতি নিয়ে ৩/৪টা গার্ল ফ্রেন্ড বানিয়েছি। অবৈধ আয়ের টাকা এখন আর পরিবারের লোকদের একাউন্টে রাখি না, রাখি গার্ল ফ্রেন্ডদের একাউন্টে, যাতে ধরা না পড়ি।
এতে আমাদের লাভ ২টা এক-টাকাটা নিরাপদে থাকে আর গার্ল ফ্রেন্ডদের সাথে একটু মাস্তি করলেও বউ কিছু বলে না। বড় অংক হলে সরাসরি বিদেশে পাঠিয়ে দিই হুন্ডি কিংবা অন্যভাবে।
আমরা প্রিন্ট ও ইলেক্ট্রনিক্স মিডিয়া কন্ট্রোল করি বা করতাম বড় বড় ঠিকাদারকে দিয়ে মোটা অংকের টাকার বিজ্ঞাপন দিয়ে কিন্তু সোশ্যাল মিডিয়া আর নিউজ পোর্টাল আমাদের সর্বনাশ করে ফেলেছে। এখন আর সব দোষ সরকারের ঘাড়ে চাপাতে পারছি না।
কিন্তু কয়েকদিন ধরে নিউজ পোর্টাল আর সোশ্যাল মিডিয়ায় আমাকে নিয়ে সাম্প্রতিক যা হচ্ছে তাতে আমার অতীত বর্তমান সব চলে আসছে। আমাদের প্রায় ন্যাংটো করে ফেলেছে। ছেলে মেয়েদের কাছে মুখ দেখাতে পারছি না।
এতে আমার ভিতরের মানুষটাও যেন জেগে উঠেছে, তাই আমি খুব কষ্ট পাচ্ছি আমার এই কৃতকর্মের জন্য। আমাকে ক্ষমা করুণ, আমাকে ভালো হবার সুযোগ দিন আপনারা সবাই।
সুত্রঃ দা বাংলাদেশ টুডে