গোপনে গ্রাহকদের ‘পকেট কাটছে’ বাংলালিংক
ভাস সার্ভিস প্রোভাইডারদের কারণে গ্রাহকদের টাকা গচ্ছা দিতে হচ্ছে বলে দাবি বাংলালিংকের
গ্রাহকদের অজান্তে ভ্যালু অ্যাডেড সার্ভিস (ভাস) সেবা চালু করে গোপনে টাকা কেটে নিচ্ছে লোকসানে থাকা টেলিকম অপারেটর বাংলালিংক। অপারেটরটির বেশ কয়েকজন গ্রাহক এর ভুক্তভোগী হয়েছেন।
এমন অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে ভাস প্রোভাইডারদের ওপর দোষ চাপিয়ে এ ধরনের ঘটনা ঘটে বলে পরোক্ষভাবে স্বীকার করে নিয়েছে এই টেলিকম অপারেটরটি।
অপারেটরটির ভুক্তভোগীদের অভিযোগ, প্রতিষ্ঠানটি তাদের না জানিয়ে বা তাদের অবর্তমানে ভাস সেবা চালু করে দিচ্ছে। এতে আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন তারা।
ভাস সেবার মাধ্যমে ক্ষতিগ্রস্তদের একজন বাংলালিংক ব্যবহারকারী মোক্তাদির হোসেন। সম্প্রতি চার্জ লিস্ট নামের একটি নম্বর থেকে এসএমএস পান তিনি। ১৭ অক্টোবর তার মোবাইলে আসা ওই ছয়টি মেসেজে তাকে জানানো হয়, তিনি ছয়টি ভ্যালু অ্যাডেড সার্ভিস, তথা ভাস গ্রহণ করেছেন। এতে তার কাছ থেকে ছয়টি সেবার প্রত্যেকটির জন্য ১৯ টাকা ৫২ পয়সা কেটে নেওয়া হয়। অর্থাৎ, তার মোবাইল থেকে ১১৭.১২ টাকা কেটে নেওয়া হয়েছে।
মোক্তাদিরের দাবি, তিনি এ ধরনের সার্ভিস সম্পর্কে কখনো শোনেননি, চালু তো দূরের কথা। পরবর্তী সময়ে তিনি সার্ভিসগুলো বন্ধের জন্য নির্দিষ্ট নম্বরে এসএমএস পাঠান। এর মধ্যে চারটি সার্ভিস বন্ধ করতে সক্ষম হন এবং একটি সার্ভিস বন্ধ করতে ব্যর্থ হন।
মোক্তাদির আরও জানান, একটি সার্ভিস বন্ধের এসএমএস পাঠালেও সেটি সফল হয়নি। এ ছাড়া অপর একটি সার্ভিস বন্ধের জন্য এসএমএস পাঠালে ফিরতি এসএমএসে তাকে জানানো হয়, তিনি ওই সেবা নেননি। বিষয়টি বিস্তারিত জানিয়ে ভোক্তা অধিকারে মামলা করেন তিনি। তবে এর সুরাহা হয়নি এখনো।
ভুক্তভোগী ওই গ্রাহক বলেন, ‘২৪ অক্টোবর আমার কাছে ফের ৭০৭৭ থেকে একটি এসএমএস আসে। সেখানে জানানো হয়, মোবাইল পোর্টালের জন্য গত সাত দিনে আমার কাছ থেকে ১৯ টাকা ৫২ পয়সা কেটে নেওয়া হয়েছে। ১৭ তারিখে আমি এই সার্ভিসটি বন্ধের জন্য এসএমএস পাঠালেও সেটি সেন্ড হয়নি। সেখানে থাকা ০১৯৭৭-৩২৬৩৬৭ নম্বরে কল দিলেও কেউ কল রিসিভ করেননি।’
শুধু মোক্তাদির নন, গত তিন মাসে (জুলাই থেকে সেপ্টেম্বর) ভাস সম্পর্কিত এ ধরনের অভিযোগ বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশনে (বিটিআরসি) জমা পড়েছে মোট ৫২টি। ‘১০০’ নম্বরে কল দিয়ে জুলাই মাসে ভাস সম্পর্কিত অভিযোগ জানিয়েছেন ১৪ জন, আগস্ট মাসে ২১ জন এবং সেপ্টেম্বর মাসে ১৭। এদের মধ্যে অপর একজন ভুক্তভোগী মোহাম্মদ সাদ্দাম।
এ বিষয়ে সাদ্দাম প্রিয়.কমকে জানান, তিনি একজন বাংলালিংক ব্যবহারকারী। বেশ কিছুদিন ধরে তার মোবাইলে নানা সার্ভিস চালু দেখিয়ে টাকা কেটে নিয়েছে বাংলালিংক। পরে তিনি বাংলালিংক হেল্পলাইনে কল করে জানতে পারেন, তার নম্বরে ১৫টির বেশি ভাস চালু রয়েছে। তার ভাষ্য, হেল্পলাইনে থাকা কাস্টমার কেয়ার কর্মকর্তা জানান, তিনি হয়তো ভুল করে ভাস সম্পর্কিত লিঙ্কগুলোতে ক্লিক করে এসব সেবা চালু করেছেন।
সাদ্দামের দাবি, তিনি এই ধরনের কোনো লিঙ্কে প্রবেশ করেননি। তার অজান্তে এই সেবা চালু করে দিয়েছে বাংলালিংক কর্তৃপক্ষ।
এদিকে বেশ কিছু ভুক্তভোগী সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যম ফেসবুকে থাকা বাংলালিংকের পেজে ভাস সম্পর্কিত বেশ কিছু অভিযোগ করেছেন।
আহমেদ ফারহান নামের এক ফেসবুক ব্যবহারকারী মোবাইলের স্ক্রিনশটসহকারে অভিযোগ করে লেখেন, ‘আমার গেম ফ্যাক্টরি বন্ধ থাকার পরও কেন টাকা কাটা হচ্ছে?’
তার দেওয়া স্ক্রিনশটে দেখা যায়, ২ অক্টোবর তিনি তার মোবাইল থেকে ২১২৭০ নম্বরে একটি সেবা বন্ধের জন্য রিকোয়েস্ট পাঠান। ফিরতি মেসেজে তাকে জানানো হয়, তিনি এই সেবাটি ইতোমধ্যে বন্ধ করেছেন।
একই দিন আরেকটি মেসেজের মাধ্যমে তাকে জানানো হয়, গেম ফ্যাক্টরি সেবার জন্য তার মোবাইল থেকে দুই টাকা ৪৪ পয়সা কেটে নেওয়া হয়েছে।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, প্রোয়োরিটেক, সিমবায়োটিক, গেমসমোবি, মোবিবাজ, গেমফ্যাক্টরি, মোবাইল পোর্টালসহ আরও বেশ কয়েকটি ভাস সেবার মাধ্যমে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন গ্রাহকরা।
বাংলালিংকের ভাষ্য
উপরোক্ত ভাস সেবাগুলো বাংলালিংকের কি না জানতে চাইলে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশনের (বিটিআরসি) নিয়ম অনুযায়ী, বিভিন্ন কনটেন্ট প্রোভাইডার অপারেটরদের সঙ্গে চুক্তিসাপেক্ষে এই সার্ভিসগুলা দিয়ে থাকে।
বাংলালিংকের গ্রাহকদের অভিযোগ, তাদের নম্বরে এসব ভ্যালু অ্যাডেড সার্ভিস আপনাআপনি চালু হচ্ছে। এতে তারা আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন।
এ বিষয়ে বাংলালিংকের পদক্ষেপের বিষয়ে জানতে চাইলে প্রতিষ্ঠানটির জ্যেষ্ঠ ব্যবস্থাপক (করপোরেট কমিউনিকেশনস) অঙ্কিত সুরেকা বলেন, গ্রাহকদের অনুমতি ছাড়া স্বয়ংক্রিয়ভাবে ভ্যালু অ্যাডেড সার্ভিস চালু হওয়ার কোনো সুযোগ নাই।
সুরেকার ভাষ্য, ‘বাংলালিংকের সার্ভিসগুলো কীভাবে অ্যাকটিভেট ও ডিঅ্যাকটিভেট করতে হয়, সে ব্যাপারে গ্রাহকরা প্রয়োজনীয় নির্দেশনা পেয়ে থাকেন। নির্দেশনাগুলো অনুসরণ করে গ্রাহকরা সহজেই আমাদের যেকোনো সার্ভিস চালু বা বন্ধ করতে পারেন। এ ছাড়া কোনো সার্ভিস চালুর ক্ষেত্রে গ্রাহকদের কাছে দুই ধাপে অনুমতি নেওয়া হয়। এর পরেও যদি সার্ভিসটি চালুর ক্ষেত্রে গ্রাহক অসন্তুষ্টি থাকে, আমরা তদন্তসাপেক্ষে গ্রাহকের টাকা ফেরত দিই এবং তার অনুমতিসাপেক্ষে সার্ভিস ডিঅ্যাকটিভেট করে দেই।’
ভাস সার্ভিস প্রোভাইডারদের কারণে গ্রাহকরা এমন সমস্যায় পড়েন বলে দাবি করেন বাংলালিংকের এই কর্মকর্তা।
ভাস প্রোভাইডারদের ওপর দোষ চাপিয়ে তিনি বলেন, ‘বাংলালিংকে গ্রাহকদের প্রতিটি অভিযোগ অত্যন্ত গুরুত্বসহকারে তদন্ত করা হয়। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে তদন্ত করতে গিয়ে দেখা যায়, গ্রাহক ভুলবশত নিজেই সার্ভিসটি চালু করছে।’
‘এ ছাড়াও তদন্ত করতে গিয়ে যদি আমরা পাই যে কোনো কন্টেন্ট প্রোভাইডার ইচ্ছাকৃতভাবে এটা করছেন, আমরা আমাদের কোম্পানি পলিসি অনুযায়ী তাদের বিরুদ্ধে তৎক্ষণাৎ ব্যবস্থা গ্রহণ করি। পূর্বে অনেকের সাথে তদন্তসাপেক্ষে চুক্তি বাতিলও করা হয়েছে।’