পর্যটক টানছে গুলিয়াখালী সৈকত
‘এখানে এসে মনটা ভরে গেছে। আমি যতটা ভেবেছিলাম তার চেয়ে অনেক অনেক সুন্দর গুলিয়াখালী সমুদ্রসৈকত। উফ্! কী বড় বড় ঢেউ! উত্তাল সাগর যেন সব কিছু ভেঙে গুঁড়িয়ে দিতে চায়! আর ঢেউগুলো ঠিক যেখানে এসে শেষ হয় সেখানেই সবুজ বন। এ বনের সবুজ-সজীব রূপ বর্ণনা করার মতো ভাষা আমার জানা নেই।’
চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডের মুরাদপুর ইউনিয়নের গুলিয়াখালী সমুদ্রপারে বেড়াতে এসে এই অনুভূতি ব্যক্ত করেন ঢাকার সোনারগাঁ থেকে আসা ঢাকা কলেজের ছাত্র মো. এরশাদ উল্লাহ। তিনি গতকাল শুক্রবার সকালে পাঁচ সঙ্গীসহ ঢাকা থেকে সীতাকুণ্ডে আসেন। তাঁর সাথীরা হলেন মো. জসীম, আকলিমা, ফরহাদ, আনোয়ার ও মুক্তা। তাঁরা সহপাঠী। তাঁদের মতো আরো অনক পর্যটক আসে এই সাগরপারে। দিন দিন জনপ্রিয় হয়ে উঠছে এই পর্যটন স্পট।
এরশাদ বলেন, ‘আমরা ভ্রমণপিপাসু মানুষ। সুযোগ পেলেই বেরিয়ে পড়ি। এর আগে কক্সবাজার, বান্দরবান, সিলেট, ময়মনসিংহসহ বিভিন্ন অঞ্চলে ঘুরেছি।’ তিনি জানান, এবার একটি নতুন জায়গা দেখার পরিকল্পনা ছিল তাঁদের। এর মধ্যে ইন্টারনেটে বিভিন্ন বন্ধুর কাছে জানতে পারেন সীতাকুণ্ডের গুলিয়াখালী সমুদ্রসৈকতের কথা। পরে আরো খোঁজখবর নিয়ে এর সৌন্দর্য সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়ার পরই তাঁরা এখানে এসেছেন।
এই দলের সঙ্গী মো. জসীম বলেন, ‘ভ্রমণে অনেক কিছু জানার থাকে। নতুন নতুন পরিবেশ সম্পর্কে অভিজ্ঞতা হয়। তাই ভ্রমণ ভালোই উপভোগ করি। এবার সীতাকুণ্ডের মুরাদপুর গ্রামের এই গুলিয়াখালী সৈকতে এসেও অনেক অভিজ্ঞতা হয়েছে।’ তিনি বলেন, ‘ঢাকা থেকে ট্রেনে সীতাকুণ্ডে এসে নামি আমরা। তারপর স্থানীয় লোকজনের সঙ্গে কথা বলি। সীতাকুণ্ড সদরের নামার বাজার থেকে সিএনজি অটোরিকশায় সোজা গুলিয়াখালী সাগরপারে চলে আসি।’
জসীম বলেন, ‘এখানে আসার আগে অনেক সংশয় ছিল মনে। কেমন হবে জায়গাটি। কিন্তু এসে বুঝলাম ভুল করিনি। সত্যিই অপরূপ। এককথায় চমৎকার মনোরম একটি পরিবেশ। মহাসড়ক থেকে জায়গাটি কয়েক কিলোমিটার দূর, এ কথা ঠিক। কিন্তু ভ্রমণের নেশায় গ্রাম্য প্রকৃতি দেখতে থাকা মানুষের কাছে এ দূরত্ব উপভোগ্য বটে। সব মিলিয়ে ভালো একটি সফর শেষ করলাম।’ তাঁদের সঙ্গী মুক্তা সাংবাদিক পরিচয় পেয়ে বলেন, “এত্ত সুন্দর নিরিবিলি একটি পরিবেশ, ভাবা যায় না। আমরা ঢাকার জঞ্জালের মধ্যে থাকি বলা চলে। একটি দিনের জন্য এখানে এসে মনটা ভরে গেল। বহুদিন পরে যেন অনেক পাখির কিচিরমিচির শুনলাম। সাগরের পাশ দিয়ে যাওয়া খালে নৌকা বেয়ে যেতে যেতে একজন মাঝি হঠাৎ গেয়ে উঠলেন ‘ওরে নীল দরিয়া’! বিশ্বাস করুন, এ পরিবেশে তাঁর মুখে এই গানটা এত চমৎকার লাগছিল যে বলে বোঝাতে পারব না। কিন্তু গান গাইতে গাইতে সে মাঝি খাল থেকে সাগরের দিকে দৃষ্টিসীমার বাইরে চলে গেলেও যেন রেশ রয়ে যায়। তাঁর সেই গানের সুর তখন আমাদের সবার মুখে!”
মুক্তা আরো বলেন, ‘এখানে বালুচর নেই। সাগরের শেষ প্রান্ত এসে ছুঁয়েছে সবুজ কেওড়া বন। এই বন এতই সবুজ ও সজীব যে প্রকৃতির এ রূপ দেখে মুগ্ধ হবে সবাই। তা ছাড়া এই সাগরপারটিতে এক অসম্ভব নীরবতা বিরাজ করছে। সব মিলিয়ে পরিবেশটি অসাধারণ।’ তিনি বলেন, সরকার যদি এই পর্যটন স্পট পরিকল্পিতভাবে গড়ে তোলে তাহলে এটি দেশের অন্যতম একটি পর্যটন স্পটে রূপ নেবে সহজেই।
গুলিয়াখালী সাগরপার ঘুরে দেখা গেছে, আরো অসংখ্য পর্যটক ঘুরে বেড়াচ্ছে এখানে। তাদের কেউ এসেছে চট্টগ্রাম থেকে, কেউ বা ফেনী-কুমিল্লার মানুষ। আছে আরো বহু অঞ্চলের তরুণ-তরুণী, শিক্ষার্থীসহ বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ।
কুমিল্লার মিয়াবাজার এলাকার বাসিন্দা ক্যাডেট কলেজের বিজ্ঞান বিভাগের উচ্চ মাধ্যমিকের শিক্ষার্থী মো. একরাম হোসেন বলে, ‘আগে থেকেই ইন্টারনেটের মাধ্যমে গুলিয়াখালী সাগরের কথা শুনে আসার পরিকল্পনা করেছি। বন্ধু সাহেদকে সঙ্গে নিয়ে চলে এসে দেখলাম ভুল করিনি।’ সে বলে, উত্তাল সাগরের ঢেউ আর সবুজ প্রকৃতিই হলো এ পর্যটন স্পটের প্রধান আকর্ষণ! তবে যে হারে পর্যটকের আগমন হচ্ছে সেভাবে নিরাপত্তাব্যবস্থা ও ভালো মানের খাবারের হোটেল এখনো এই সাগরপারে গড়ে ওঠেনি। প্রশাসন ও স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা যদি এদিকটায় একটু নজর দেন তাহলে যারা দূর থেকে আসবে তারা স্বস্তি নিয়ে ভ্রমণ শেষ করতে পারবে। তিনি জানান, এখন ভালো কিছু খেতে চাইলেও আবার কয়েক কিলোমিটার ঘুরে সীতাকুণ্ড পৌর সদর বাজারে যেতে হচ্ছে। সাগরপারে রয়েছে দু-একটি ছোট দোকান। সেখানে ভালোভাবে দুপুরের খাবারেরও ব্যবস্থা হয় না। এসব ব্যাপারে উদ্যোগী না হলে পর্যটকরা হতাশ হবে।
গুলিয়াখালী গ্রামের বাসিন্দা মো. আনিস ও মো. জানে আলম বলেন, ‘এখানে এত বেশি পর্যটক আসছে যে যা আমরা কখনো কল্পনাও করিনি। নিরাপত্তাব্যবস্থা দুর্বল হওয়ায় কিছুদিন আগে ছয়জন পর্যটকের সর্বস্ব ছিনতাই হয়।’
মুরাদপুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মো. জাহেদ হোসেন নিজামী বাবু বলেন, ‘এখানে দিন দিন পর্যটক বাড়ছে। এ সুযোগ নিয়ে কিছু বখাটে চুরি-ছিনতাই এসব করতে চায়। দু-একটি বিচ্ছিন্ন ঘটনাও তারা ঘটিয়েছে। তবে খবর পেয়ে পুলিশ নিরাপত্তাব্যবস্থা নিয়মিত তদারকি করছে। ফলে নতুন করে কোনো ঘটনা ঘটেনি। আমিও চৌকিদার নিয়োগ ও এলাকার মানুষকে কাজে লাগিয়ে পর্যটকদের নিরাপত্তা জোরদার করেছি।’