করোনায় পর্যটন খাতে নেমেছে ধস
বৈশ্বিক মহামারি করোনাভাইরাসে (কোভিড-১৯) আক্রান্ত হয়ে শুক্রবার পর্যন্ত বিশ্বব্যাপী মৃতের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১০ হাজার ৪৮ জনে। এখন পর্যন্ত এ ভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছেন বিশ্বের ২ লাখ ৪৫ হাজার ৬৩০ জন।
এদিকে বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়া প্রাণঘাতী এই করোনাভাইরাসের কারণে সারা বিশ্বের মতো বাংলাদেশের পর্যটন খাতেও ধস নেমেছে। গত কয়েকদিনে পরিস্থিতি আরও খারাপ হয়ে পড়েছে।
কক্সবাজার, রাঙামাটি, বান্দরবান, খাগড়াছড়িসহ বিভিন্ন পর্যটন এলাকায় ইতোমধ্যে পর্যটকদের যাতায়াতে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়েছে। সিলেট, মৌলভীবাজারসহ আরও কয়েকটি জায়গায় সীমিত করা হয়েছে চলাচল। এছাড়া বিদেশি পর্যটকদের সংখ্যাও নেমে এসেছে শূন্যের ঘরে। সবমিলিয়ে বাংলাদেশের পর্যটনখাতে বিশাল ধস নেমেছে।
পর্যটন সংশ্লিষ্টরা জানান, করোনাভাইরাসের কারণে এবার ব্যবসায় যে ধস নামছে, তা কাটিয়ে ওঠতে অনেক সময় লাগবে। চলতি বছরের শুরুতে পর্যটনে নতুন গতি এসেছিল। প্রতিনিয়ত পর্যটকদের আনাগোনা বাড়ছিল। কিন্তু করোনাভাইরাস মহামারীর রূপ নেওয়ায় সেই গতি থমকে গেছে। বর্তমানে দেশের বিভিন্ন হোটেল, মোটেল, রেস্ট হাউজ ও রিসোর্ট প্রায় পর্যটকশূন্য অবস্থায় রয়েছে। গত এক সপ্তাহেরও বেশি সময় ধরে নতুন করে কোনো রুম বুকিং হচ্ছে না। আগে যে বুকিং ছিল, সেগুলোও বাতিল হচ্ছে।
করোনাভাইরাসের কারণে একেবারেই বন্ধ হয়ে গেছে চায়ের রাজধানীখ্যাত শ্রীমঙ্গল। মৌলভীবাজার প্রতিনিধি জানান, মৌলভীবাজারের সব কয়টি পর্যটন স্পটই এখন শূন্য। একই অবস্থা মৌলভীবাজার সদর এবং কমলগঞ্জের হোটেল, মোটেল, রেস্টহাউজগুলোতেও।
শ্রীমঙ্গল উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা নজরুল ইসলাম বলেন, পৃথিবীর অধিকাংশ দেশেই করোনাভাইরাস ছড়িয়ে পড়েছে। ইতোমধ্যে বাংলাদেশেও এটার প্রাদুর্ভাব দেখা দিয়েছে। আর শ্রীমঙ্গল মৌলভীবাজার একটা পর্যটনসমৃদ্ধ এলাকা। প্রতিদিন দেশ বিদেশের পর্যটকরা এই জায়গায় বেড়াতে আসেন। তাই আপাতত পর্যটকদের এই অঞ্চলে ভ্রমণের ওপর প্রশাসনের পক্ষ হতে নিরুৎসাহিত করা হয়েছে। সেই সঙ্গে সব হোটেল-মোটেল রিসোর্টকে আগাম বুকিং নেওয়া থেকে বিরত থাকতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। সব হোটেল, রিসোর্ট, মোটেলে পর্যটক রয়েছে তারা যেন পর্যটকদের তথ্য দেন পাশাপাশি নতুন করে কোনো হোটেল মোটেল রিসোর্ট মালিক যেন নতুন করে বুকিং না নেন।
শ্রীমঙ্গলের পাঁচতারকা হোটেল গ্র্যান্ডসুলতানের এজিএম আরমান খান বলেন, করোনা ভাইরাসের কারণে প্রত্যেকের মধ্যেই আতংক বিরাজ করছে। তাই কোনো পর্যটকই আসছেনা। বিদেশি পর্যটক দূরের কথা দেশি পর্যটকই আসছেন না। তাছাড়া প্রশাসন থেকে পর্যটকদের বুকিং না নেওয়ার জন্য নিষেধাজ্ঞা রয়েছে।
এছাড়া করোনাভাইরাসের ঝুঁকি এড়াতে পর্যটন নগরী কক্সবাজারে নতুন করে পর্যটকদের না যাওয়ার জন্য বলা হচ্ছে জেলা প্রশাসকের পক্ষ থেকে। মাইকিং করে ফেরত যেতে বলা হচ্ছে পর্যটকদের। পাশাপাশি সমুদ্র সৈতক থেকে পর্যটকদের সরিয়ে নেওয়া হচ্ছে।
কক্সবাজারের ভারপ্রাপ্ত জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ মাসুদুর রহমান মোল্লা জানান, হোটলে-মোটেলসহ জেলার বিভিন্ন স্থানে জনসমাবেশ, বিনোদন অনুষ্ঠান পরিবেশনসহ সবধরনের জনসমাগমের আয়োজনে নিষেধাজ্ঞা প্রদান করা হয়েছে। পাশাপাশি আগত পর্যটকদের ফিরে যেতে অনুরোধ করা হচ্ছে।
অন্যদিকে, করোনা আতঙ্কে পাহাড়ের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্যের লীলাভূমি রাঙ্গামাটির সাজেক ভ্যালিতেও পর্যটকের সংখ্যা কমেছে। সাজেকে অবস্থিত বিভিন্ন কটেজ ও রিসোর্ট মালিকরা জানিয়েছেন, গত কয়েকদিন পর্যটকের উপস্থিতি একেবারেই কমে গেছে। অনেকেই আগের অগ্রিম বুকিংও বাতিল করেছেন।
করোনাভাইরাস (কোভিড-১৯) বিষয়ে সতর্কতার কারণে পার্বত্য জেলা রাঙ্গামাটিতে পর্যটকদের ভ্রমণে নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে জেলা প্রশাসন। আরেক পার্বত্য জেলা বান্দরবানেও পর্যটকদের ভ্রমণে নিরুৎসাহিত করা হয়েছে জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে।
রাঙ্গামাটির জেলা প্রশাসক মামুনুর রশিদ বলেন, পরবর্তী নির্দেশনা না দেওয়া পর্যন্ত রাঙ্গামাটির সব পর্যটন ও বিনোদন কেন্দ্রে পর্যটক ভ্রমণে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়েছে। এই নির্দেশনা যদি কেউ অমান্য করে, তার বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
রাঙ্গামাটি জেলা আবাসিক হোটেলি মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক মঈন উদ্দিন জানিয়েছেন, বুধবার যারা রাঙ্গামাটি এসেছেন, তাদের কাল (বৃহস্পতিবার, ১৯ মার্চ) সকালে রুম ছেড়ে দিতে বলা হবে। আর কাল থেকে নতুন করে কাউকে রুম ভাড়া দেওয়া হবে না। আমরা এরই মধ্যে সব হোটেল মালিককে বিষয়টি জানিয়ে দিয়েছি।
বান্দরবান জেলা প্রশাসনের এক বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, নভেল করোনাভাইরাসের সংক্রমণ প্রতিরোধের জন্য সরকার প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে জনসমাগম নিষিদ্ধ করায় বান্দরবান পার্বত্য জেলার পর্যটনকেন্দ্রগুলোতে পরবর্তী নির্দেশ না দেওয়া পর্যন্ত পর্যটকদের আগমন নিরুৎসহিত করা হলো।
বান্দরবান প্রতিনিধি জানান, বান্দরবান পার্বত্য জেলায় মেঘলা, নীলাচল, রামজাদি, মিরিঞ্জা, তিন্দু, বড় পাথর, নাফাখুম, রেমাক্রির মুখ, বড় মদকসহ অসংখ্য পর্যটন স্পট রয়েছে। অর্ধশত পর্যটন কেন্দ্রে প্রতিদিন হাজার হাজার পর্যটক ভ্রমণে আসেন। পর্যটকদের মাধ্যমে করোনাভাইরাসের বিস্তার লাভ করতে পারে— এমন আশঙ্কা স্থানীয়দের।
খাগড়াছড়ি প্রতিনিধি জানান, করোনাভাইরাস মোকাবিলায় স্থানীয় পর্যায়ে খাগড়াছড়ির সব পর্যটন কেন্দ্র বন্ধ ঘোষণা করার পর থেকে জেলা ছাড়তে শুরু করেছেন পর্যটকরা। জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে গত বুধবার থেকে অনির্দিষ্টকালের জন্য খাগড়াছড়ির সব পর্যটনকেন্দ্র বন্ধ ঘোষণার পর থেকে সাজেকসহ বিভিন্ন পর্যটন কেন্দ্রে পর্যটক নিয়ে যাওয়া বন্ধ করেছে পরিবহন শ্রমিকরা। অনেকে না জেনে পর্যটন কেন্দ্রে প্রবেশ করতে চাইলেও কর্তৃপক্ষ ও পুলিশের পক্ষ থেকে তাদের ফিরিয়ে দেওয়া হচ্ছে।
খাগড়াছড়ি সদর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মুহম্মদ রশিদ জানান, সার্বিক পরিস্থিতি মোকাবিলায় জেলা প্রশাসন ও পুলিশের পক্ষ থেকে ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনাসহ বিভিন্ন উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে।