বান্দরবানের জোড়া জলপ্রপাত

431

বান্দরবান শহরে ঢোকার সাড়ে ৭ কিলোমিটার আগে কিংবা বান্দরবান শহর কেন্দ্র থেকে ততটা দূরে রেইচা পুলিশ চেক পোস্টের পাশ দিয়ে গ্রামীণ সড়ক ধরে ৩০০ মিটার পথ এগোলেই কানে বাজে জলপ্রপাতের ঝর ঝর শব্দ। আর কয়েক কদম এগোলেই পাহাড় চুড়ো থেকে সাঁই সাঁই করে নেমে আসা জলপতনের চোখ জুড়ানো এক ছবি। এক সময় এই জলপ্রপাতের নাম ছিল ‘দরদরি।’ এখন এর নাম রূপালি জলপ্রপাত। শত শত বছর ধরে এই জলপতন হলেও চোখে পড়েনি কারো। কয়েকজন উদ্যমী যুবক ৫ একরের একটি পাহাড় কিনে জঙ্গল পরিষ্কার করতে গিয়েই বের হয়ে আসে প্রায় পুরো বছর জলপতনের মনকাড়া এই স্পট।

ওপাশে সুবিস্তৃত নীলাচল পর্যটন কেন্দ্র। মাঝখানে পাহাড়ের ঢালে ঢালে নৃ-গোষ্ঠীর গ্রাম। আর মাঝখান দিয়ে সর্পিল গতির ক্ষীণ ক্ষীণ জলধারা একত্রে মিশে প্রায় ১০০ ফুট উঁচু পাথুরে পাহাড় থেকে ধপাস করে পড়ছে সমতলে। জলপতনের এই স্থানটিতে তৈরি হয়েছে জলাশয়। আর জলপ্রপাতের পানি প্রবাহিত হতে হতে জন্ম নিয়েছে ছোট্ট খাল। ওপরের অংশ দিয়ে পানি নেমে এলেও পিচ্ছিল হওয়ায় উৎপত্তি স্থল দেখা কিছুটা কষ্টকর। কিন্তু রেইচা থেকে মেঠো (মাটির) পথ ধরে কিছুটা পথ এগুোলেই মনে ভরে যাবে বিশাল এই জলপ্রপাত দেখে। রূপালি থেকে সামান্য কিছুটা এগুোলেই আরো একটি জলপ্রপাত। স্থানীয়রা নাম দিয়েছেন ‘রূপশ্রী।’ রূপালি আর রূপশ্রী যেন একই বৃন্তে দুটি বোন।

স্থানীয়রা জানিয়েছেন, বান্দরবান-রুমা-থানচি সড়কের ৬ কিলোমিটারে অবস্থিত শৈলপ্রপাতের জলধারাই গড়িয়ে গড়িয়ে এসে জন্ম দিয়েছে রূপালি এবং রূপশ্রীকে।

সম্প্রতি বান্দরবান পার্বত্য জেলা পরিষদ, পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ড এবং অন্য আরো কয়েকটি সরকারি উন্নয়ন সংস্থা সম্ভাবনাময় এই পর্যটন এলাকায় রাস্তা-ঘাট, ব্রিজ-কালভার্ট নির্মাণ শুরু করেছে। হয়তো এই শীতের মৌসুমে গাড়িতে চড়েই দেখে আসা যাবে চমৎকার এই জলপ্রপাত।

জমির মালিকদেরই একজন মোজাম্মেল হক লিটন বলেন, ‘প্রধান সড়ক থেকে এত কাছে, এতো সহজে আর কোনো জলপ্রপাত দেখা যায় কিনা জানি না। রূপালি এবং রূপশ্রী জলপ্রপাতকে ঘিরে এখানে একটি পর্যটন কেন্দ্র গড়ে ওঠলে আমাদের উদ্যোগ সার্থক হয়ে উঠবে।’

রূপালি-রূপশ্রী জলপ্রপাতের কথা তেমন একটি ছড়িয়ে না পড়লেও একেবারেই যে তা পাদপ্রদীপের আড়ালে পড়ে আছে তেমনটি নয়। শনিবার সেখানে গিয়ে জানা গেল-এখনও প্রায় প্রতিদিনই কিছু না কিছু পর্যটক আসছে সেখানে।

রূপালি জলপ্রপাতের পাশের চায়ের দোকানদার আবু জাফর জানান, প্রতিদিন গড়ে শ দুয়েক লোক আসছেন। তিনি বলেন, ‘পর্যটকদের কেউ আসছেন দল বেঁধে, কেউ আসছেন একা একা। পরিবারের সদস্যদের নিয়েও আসছেন অনেকেই।’

কথা হয় স্ত্রী ও নিকটাত্মীয় নিয়ে বেড়াতে আসা পর্যটক আশিক রহমানের সাথে। তিনি ঢাকার মানুষ।

কীভাবে জেনেছেন, রূপালি-রূপশ্রী জলপ্রাপাতের কথা-এমন প্রশ্নের জবাবে আশিক রহমান জানান, বান্দরবান বেড়াতে এসে শহরের একজন সিএনজি ড্রাইভারের কাছ থেকে রূপালি জলপ্রপাতের কথা তিনি জানতে পারেন। আশিক রহমান বলেন, ‘এসেই দেখি-একটি নয়, দুটি জলপ্রপাত আছে এখানে। আহ! এত কাছেই এমন সুন্দর দৃশ্য আমার ভাবনারও অতীত ছিল।’

আশিক রহমানের সাথে কথা বলে জানা গেল, অটোরিকশা ড্রাইভারই তাঁদেরকে গাইড হিসেবে একটি শিশুকে ঠিক করে দিয়েছেন।

তাঁর সাথেই কিছুটা কাদা মাড়িয়ে বিনা কষ্টে চলে এসেছেন রূপালির কাছাকাছি। এরপর নুড়ি পাথরের ঝিরিতে হেঁটে হেঁটেই চলে যান রূপশ্রীর কাছে। সেখানেই তারা ঝর্নার জলে গোসল সেরে নিয়েছেন।

‘বেশ ভালো লাগলো’-বললেন আশিক রহমানের নব পরিণীতা স্ত্রী। রাশেদ, সাহেদ, সৈকত, আরিফুল, নকুল, মিনহাজ দল বেঁধে এসেছেন রূপালি-রূপশ্রী দেখতে। ফিরে যাওয়ার সময় কথা হয় তাঁদের সাথে।

দলের নেতা গোছের সাহেদ বললেন, ‘পর্যটকদের নিয়মিত আগমন ঘটায় এই এলাকায় নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিয়ে ভাবা দরকার।’ তিনি বলেন, ‘এলাকাটি অনেকটা জনমানবহীন। এখানে যুবকদের জন্যে খুব একটা শংকার কারণ হয়তো নেই। কিন্তু যাঁরা পরিবারের নারী সদস্যদের নিয়ে আসেন, তাঁরা নিরাপত্তাহীনতার শঙ্কায় ভুগতে পারেন। তাই সার্বক্ষণিক নিরাপত্তা কর্মী এবং রেজিস্টার্ড গাইড রাখার কথা চিন্তুা করা যেতে পারে।’

তবে নিজেকে জলপ্রাপাতের কেয়ার টেকার পরিচয় দিয়ে চায়ের দোকানী আবু জাফর জানান, তিনি এখানে আছেন চার বছরেরও বেশি। কিন্তু কখনো কোনো খারাপ ঘটনা ঘটেনি। তিনি জানান, পর্যটকদের আসা-যাওয়ায় এলাকাবাসীর বাড়তি কিছু আয় হচ্ছে। তাই এখানে যাতে নেতিবাচক কোনো ঘটনা ঘটতে না পারে-এলাকাবাসী সেদিকেও নজর রাখেন।

আবু জাফর জানান, এই জলপ্রপাত দেখতে কোনো টাকা-পয়সা লাগে না। তাই আয়ের উৎস না থাকায় নিরাপত্তা কর্মী রাখা যাচ্ছে না।

Leave A Reply

Your email address will not be published.