অন্ধকারে ঢেকে যাওয়া শ্রাবণের রাত
এম. নজরুল ইসলাম:
তোমার ছেলেরা মরে গেছে প্রতিরোধের প্রথম পর্যায়ে,
তারপর গেছে তোমার পুত্রবধূদের হাতের মেহেদী রঙ,
তারপর তোমার জš§সহোদর, ভাই শেখ নাসের,
তারপর গেছেন তোমার প্রিয়তমা বাল্যবিবাহিতা পতœী,
আমাদের নির্যাতিতা মা।
সেই রাতের কল্পকাহিনী শীর্ষক কবিতায় কবি নির্মলেন্দু গুণ এভাবেই একটি চিত্রকল্প এঁকেছেন।
আসলে, কেমন ছিল সেই রাতÑযে রাতে নিহত হলেন পিতা, ঘাতকের নির্মম বুলেটে? সেটা ছিল শ্রাবণের শেষ রাত। সে রাতে অঝোর ধারায় বৃষ্টি ঝরেনি। আকাশেও ছিল না ঘোর কৃষ্ণবর্ণ মেঘ। আকাশে কি চাঁদ ছিল? জোছনা কি গলে গলে ঝরেছিল, পেয়েছিল ঘাস-ফুল-মাটির পরশ? সে রাতে কি কালো মেঘ ঢেকে দিয়েছিল আকাশের চাঁদ? জোছনাকে কি গ্রাস করেছিল রাহুর অশুভ ছায়া? কেমন ছিল সে রাতের প্রকৃতি? পরদিন প্রভাতে নতুন সম্ভাবনার ইঙ্গিত দিয়ে যে রাত নেমেছিল, সেই সকাল আর কোনোদিন আসেনি বাঙালির জীবনে। সম্ভাবনার পরিবর্তে এক স্বপ্নভঙ্গের বিস্ময়-বেদনা নিয়ে শুরু হয়েছিল ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের সকাল? আমরা কেউ কি ভাবতে পেরেছিলাম, ১৫ আগস্ট সকালের সূর্য কোনো শুভ দিনের সূচনা নয়, একটি বেদনাবিধূর কালো ইতিহাসের জš§ দিতে যাচ্ছে?
বাঙালির জাতীয় জীবনে অনেক কালো অধ্যায় আছে। কিন্তু ১৫ আগস্ট রাতে রচিত হলো যে কৃষ্ণ অধ্যায়, বাংলার ইতিহাসে তার চেয়ে বেদনার আর কী আছে? নিজের বাড়িতে সপরিবারে নিহত হলেন জাতির জনক। জাতি পিতৃহীন হলো। যে জাতি মাত্র সাড়ে তিন বছর আগে বুকের রক্ত দিয়ে ছিনিয়ে এনেছে স্বাধীনতার সূর্য, সেই জাতিই কলঙ্কিত হলো পিতৃঘাতক হিসেবে। ইতিহাসের এই দায় কি কোনোদিন পরিশোধ করা যাবে?
বঙ্গবন্ধু এমন একজন মানুষ ছিলেন যাঁকে তাঁর জীবনের প্রতি পরতে নতুন করে আবিস্কার করতে হয়। তিনি সেই মানুষ, যাঁর দুই চোখে সবসময় খেলা করেছে বাংলাদেশ। এক সুন্দর, স্বচ্ছল ও উজ্জ্বল বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখেছেন তিনি। জীবনের শেষ দিনটি পর্যন্ত বাংলাদেশ ও বাঙালি জাতির চিন্তায় ব্যয় করেছেন তিনি। ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি ঢাকায় পা রাখা, এর পর বিভিন্ন স্থানে বক্তৃতায় তিনি কেবলই দেশ ও দেশের মানুষের কথা বলেছেন। মানুষের কল্যাণে যে জীবন উৎসর্গীকৃত, সেই মহৎপ্রাণ মানুষটি কেবলই মানুষের মঙ্গলের কথা ভেবেছেন। মানুষকে তিনি সহজেই আপন করে নিতে পারতেন। মানুষের মধ্যে নিজের স্বপ্ন বপন করতে পারতেন। রাষ্ট্রের প্রধান ব্যক্তি হয়েও বঙ্গবন্ধু সাধারণ্যে মিশে সাধারণের মতোই জীবপন যাপন করতে চেয়েছেন। নিজেকে কোনো ঘেরাটোপে বন্দী করতে চাননি তিনি। মানুষের সঙ্গে মিশে তাদের দুঃখ ভাগ করে নিতে চেয়েছেন। দেশের শীর্ষ ক্ষমতাধর ব্যক্তি হয়েও তাঁর বাড়িটি ছিলো সাধারণ একটি বাড়ি। বাড়ির আটপৌরে পরিবেশের সঙ্গে বাংলার সাধারণ পরিবারের অন্দর মহলের সাযুজ্য। এখানেই বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে অন্যদের তফাৎ। তিনি অসাধারণ হয়েও জীবন যাপনে ছিলেন অতি সাধারণ। স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের পর বঙ্গবন্ধুর ভাষণগুলি পর্যালোচনা করলে আমরা দেখতে পাই, তিনি শুধু দেশের মানুষকে নিয়েই ভেবেছেন।
১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি যিনি দেশে ফিরলেন নায়কের বেশে। পেলেন বীরোচিত সংবর্ধনা, তাঁকে কেন প্রাণ দিতে হলো নিজের দেশে ঘাতকের হাতে? সদ্যস্বাধীন দেশ তখনো বিধ্বস্ত। যুদ্ধের ছাপ তখনো মুছে ফেলা যায়নি। ভেঙে যাওয়া অর্থনীতির চাকা সচল করার চেষ্টা চলছে। চলছে দেশকে নতুন করে দেশ গড়ার পরিকল্পনা। মানুষের ভাগ্যোন্নয়নের ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে, সেই সময়ে কেন দেশের স্থপতিকে খুন করা হলো?
পর্যালোচনা দেখা যাবে, স্বাধীন বাংলাদেশের স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যার পরিকল্পনাটি ছিল সুদূরপ্রসারী। শুধু বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে হত্যা নয়, তাঁর আদর্শকেও নির্বাসনে পাঠানোর গভীর ষড়যন্ত্র করা হয়েছিল। ঘাতকের বুলেট সেদিন ধানমণ্ডির ঐ বাড়িতে শেখ পরিবারের কাউকে রেহাই দেয়নি। রেহাই পায়নি বঙ্গবন্ধুর শিশুপুত্র রাসেল কিংবা পুত্রবধূরাও। এই জঘন্য হত্যাকাণ্ডের ঘটনাটি যে ঘাতকচক্রের পূর্ব পরিকল্পনা, তা স্পষ্ট হয় হত্যা পরবর্তী কর্মকাণ্ড থেকেই। ঘাতকরা বঙ্গবন্ধু বা তাঁর পরিবারের সদস্য ও ঘনিষ্ঠ সহকর্মীদের হত্যা করেই ক্ষান্ত হয়নি, এ দেশের রাষ্ট্রক্ষমতা কুক্ষিগত করে হত্যাকারীদের নিরাপদ জীবন নিশ্চিত করেছিল, পুরস্কৃত করেছিল। খুনিদের রক্ষা করার জন্য দেশের সংবিধানেও হাত দেওয়া হয়েছিল। এই পৈশাচিক হত্যাকাণ্ডের বিচার রহিত করা হয়েছিল ইনডেমনিটি আইন পাস করার মাধ্যমে।
কাজেই এটা স্পষ্ট যে, সপরিবারে বঙ্গবন্ধুকে হত্যার ঘটনা শুধু ব্যক্তি মুজিবকে হত্যার প্রয়াস ছিল না, ছিল জাতির স্বাধীনতার শক্তিকে হত্যার অপচেষ্টা। ব্যক্তি বঙ্গবন্ধুকে খুন করে তারা একটি আদর্শকে খুন করতে চেয়েছিল। কিন্তু এ দেশে তা সম্ভব হয়নি, কখনো হবে না। আজকের দিনে বঙ্গবন্ধু অনেক বেশি প্রাসঙ্গিক। মুজিবাদর্শে দীক্ষিত বাঙালি চায় সামনের দিকে এগিয়ে যেতে। যে অন্ধকার দিনের যাত্রা শুরু হয়েছিল ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট থেকে, সেই অন্ধকারের পর্দা ভেদ করে ইতিবাচক দিনের যাত্রা শুরু হয়েছে।
যদিও বঙ্গবন্ধুর আদর্শের বাংলাদেশ তো এখনো গড়ে তোলা সম্ভব হয়নি। তাঁর অসম্পূর্ণ স্বপ্ন বাস্তবায়নের দায়িত্ব এদেশের প্রতিটি নাগরিকের। দারিদ্র্য দূর করে শিক্ষার আলো ছড়িয়ে দিতে হবে দেশের মানুষের মধ্যে। আগামী প্রজš§কে গড়ে তুলতে হবে বাঙালি জাতীয়তাবাদের আদর্শে। বঙ্গবন্ধু এদেশের মানুষের মুক্তির জন্য সংগ্রাম করেছেন। সেই মুক্তি এখনো অর্জিত হয়নি। কাক্সিক্ষত সেই মুক্তির লক্ষ্যে আমাদের সংঘবদ্ধভাবে কাজ করতে হবে।
১৯৭৫ থেকে ২০১৮, চলিশ বছর অতিক্রান্ত। আরো হাজার বছর যাবে। কিন্তু বঙ্গবন্ধু সবসময় স্বাধীন বাংলাদেশের জন্য প্রাসঙ্গিক থাকবেন। তাঁর কথা, তাঁর কাজ অনুসরণের ভেতর দিয়েই তাঁকে শ্রদ্ধা জানাতে হবে। বঙ্গবন্ধু রাজনীতি করেছিলেন দেশের মানুষের জন্য। নির্যাতন-নিপীড়ণ মেনে নিয়েছিলেন মানুষের কল্যাণের কথা চিন্তা করেই। তাঁর মতো নিঃস্বার্থ রাজনীতিবিদ বিরল। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট আমরা এই মানবপ্রেমী অসাধারণ রাষ্ট্রনায়ককে হারিয়েছি। তিনি বেঁচে থাকলে আজকের বাংলাদেশ অনেকদূর এগিয়ে যেত। বাবার আদর্শের পতাকা বহন করে তাঁর কন্যা শেখ হাসিনা আজ বাংলাদেশকে নেতৃত্বে দিচ্ছেন। আমাদের ভরসা সেখানেই। আমরা জানি, তাঁর যোগ্য নেতৃত্ব আমাদের পৌঁছে দেবে সেই বাংলাদেশে, যে দেশের স্বপ্ন দেখেছিলেন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। যদিও জানি, ষড়যন্ত্র থেমে নেই। কুচক্রী মহল এখনো সক্রিয়।
আজ ১৫ আগস্ট স্মরণ করি অন্ধকারে ঢেকে যাওয়া শ্রাবণের রাতটিকে। যে রাতে নিহত হলেন জাতির পিতা। পরম শ্রদ্ধায় স্মরণ করি সেই মহান বাঙালিকে, যাঁর পরিচয়ে বাঙালি পরিচিত। বিশ্বজুড়ে তিনিই তো বাঙালির পরিচয়সূত্র।
লেখক: অস্ট্রিয়া প্রবাসী লেখক, মানবাধিকারকর্মী ও সাংবাদিক