আল্লাহ যাদের প্রতি দয়া করবেন
আল্লাহ রাব্বুল আলামিন স্বয়ং তার সর্বশ্রেষ্ঠ সৃষ্টি মানুষকে অত্যন্ত ভালোবাসেন। কুরআনুল কারিমে একাধিক আয়াতে এসেছে- ‘আল্লাহ তাদের ভালোবাসেন এবং তারা আল্লাহকে ভালোবাসে।’ (সুরা মায়েদা : আয়াত ৫৪) অন্য আয়াতে আল্লাহপাক ইরশাদ করেন, ‘আর তিনি (আল্লাহ) তোমাদের মধ্যে পারস্পরিক ভালোবাসা ও দয়া সৃষ্টি করেছেন।’ (সুরা আর-রুম : আয়াত ২১)
আল্লাহ তাআলা আমাদের শ্রেষ্ঠ সৃষ্টি হিসেবে এজন্যই সৃষ্টি করেছেন, আমরা যেন আল্লাহ তাআলার নির্দেশের ওপর আমল করি। আল্লাহপাক যদিও আমাদের তার ইবাদতের জন্য সৃষ্টি করেছেন। অথচ আজ আমরা আমাদের সৃষ্টির উদ্দেশ্য ভুলে নানান মন্দ কাজে লিপ্ত রয়েছি।
এমন কোনো অন্যায় কাজ নেই যা আমার দ্বারা সংঘটিত না হচ্ছে। আজ আমাদের মাঝে দয়ামায়া এতটাই কমে গেছে যে, আমারই সামনে বা আমার প্রতিবেশী কেউ না খেয়ে দিনাতিপাত করলেও তার প্রতি আমার হৃদয় থেকে সামান্যতম দয়া প্রদর্শনের বহিঃপ্রকাশ ঘটে না। একাধিক হাদিসে তা ফুটে ওঠেছে-
হজরত আব্দুল্লাহ বিন মাসউদ রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ‘সব সৃষ্টি-প্রাণীকূল আল্লাহর পরিবার-পরিজন। অতএব আল্লাহ তাআলার কাছে তার সৃষ্টজীবের মাঝে সে-ই প্রিয়ভাজন যে তার অধীনস্ত ও সৃষ্টজীবের সঙ্গে দয়ার্দ্র আচরণ করে এবং তাদের প্রয়োজনের প্রতি যত্নবান থাকে।’ (মিশকাত)
হজরত আলি রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেন রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ‘একজন মুসলমানের কাছে অপর মুসলমানের ৬টি অধিকার প্রাপ্য-
– তার সঙ্গে সাক্ষাত হলে সালাম (আসসালামু আলাইকুম) বলা।
– সে হাঁচি দিলে ‘ইয়ারহামুকুমুল্লাহ’ বলা।
– সে অসুস্থ হলে তার সেবা-শুশ্রুষার জন্য যাওয়া।
– সে ডাকলে তার ডাকে সাড়া দেওয়া।
– সে মারা গেলে তার জানাজায় শামিল হওয়া।
– নিজের জন্য যা পছন্দ কর, অপরের জন্যও তা-ই পছন্দ করা। আর তার অবর্তমানে তার কল্যাণ কামনা করা।’ (দারেমি)
হজরত আব্দুল্লাহ ইবনে ওমর রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন-
– একে অপরকে হিংসা করো না।
– একে অন্যের ক্ষতি সাধনের জন্য প্রতিযোগিতামূলকভাবে (পণ্যের) অলীক মূল্য বৃদ্ধি করো না।
– একে অপরের প্রতি বিদ্বেষ রেখো না।
– একে অপরকে পৃষ্ঠ প্রদর্শন করো না অর্থাৎ সম্পর্কহীনতার ব্যবহার করো না।
– একজনের দাম-দর করার সময়ে অপরজন দাম করবে না।
– আল্লাহ তাআলার বান্দা হিসেবে এবং পরস্পর ভাই-ভাই হয়ে থাক।
– মুসলমান ভাইয়ের প্রতি অন্যায় করতে পারে না।
– তাকে হীন জ্ঞান করতে পারে না, তাকে লজ্জিত করতে পারে না।
রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম নিজ বুকের দিকে ইঙ্গিত করে বলেছেন, ’আত-তাকওয়া হাহুন্না অর্থাৎ ‘তাকওয়া এখানে’। এ বাক্যটি তিনি তিনবার পুনরাবৃত্তি করেন। এরপর বলেন-
‘নিজের কোনো মুসলমান ভাইকে অবজ্ঞা বা তাচ্ছিল্যের দৃষ্টিতে দেখাটাই কোনো মানুষের দুর্ভাগা সাব্যস্ত হওয়ার জন্য যথেষ্ট। প্রত্যেক মুসলমানের রক্ত, সম্পদ, সম্মান ও সম্ভ্রম অন্য মুসলমানের জন্য হারাম এবং সম্মানের যোগ্য।’ (মুসলিম)
হজরত আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম (আরও) বলেছেন-
– ‘যে ব্যক্তি কোনো মুসলমানের জাগতিক কোনো অস্থিরতা ও কষ্ট লাঘব করেছে এবং যে ব্যক্তি কোনো অভাবগ্রস্তের সাহায্যের ব্যবস্থা করেছে এবং তার জন্য কোনো বিষয় সহজসাধ্য করেছে আল্লাহ তাআলা পরকালে তার জন্য স্বাচ্ছন্দ্যের ব্যবস্থা করবেন।
– যে ব্যক্তি কোন মুসলমানের দোষ-ত্রুটির গোপনীয়তা রক্ষা করে, আল্লাহ তাআলা পরকালে তার দুর্বলতাও ঢেকে রাখবেন।
– যে ব্যক্তি তার ভাইয়ের সাহায্যের জন্য এগিয়ে আসবেন, আল্লাহ তাআলা তার সাহায্যের জন্য প্রস্তুত থাকেন।
– যে ব্যক্তি জ্ঞানের অন্বেষায় বের হয়, আল্লাহ তাআলা তার জন্য জান্নাতের পথ সুগম করে দেন।
– আর যারা মসজিদের কোনো কোনায় বসে আল্লাহ তাআলার কিতাব পাঠ করে এবং এর পঠন-পাঠনে লেগে থাকেন আল্লাহ তাআলা তাদের জন্য সুখ ও প্রশান্তি অবতীর্ণ করেন। আল্লাহ তাআলার রহমত তাদেরকে আচ্ছাদিত করে রাখেন। ফেরেশতারা তাদের নিরাপত্তা বেষ্টনীতে ঘিরে রাখে। আল্লাহ তাআলা তার নৈকট্যপ্রাপ্তদের কাছে তাদের কথা উল্লেখ করেন।
– যে ব্যক্তি আমলের ক্ষেত্রে শিথিলতা দেখায়, তার বংশ ও পরিবার তার পুণ্যকর্মে গতি সঞ্চার করতে পারে না অর্থাৎ বংশের জোরে কেউ জান্নাতে যেতে পারবে না।’ (মুসলিম)
হজরত আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ‘সাদকা বা দান-খয়রাত করলে সম্পদ কমে না। যে ব্যক্তি অন্যের অপরাধ ক্ষমা করে আল্লাহ তাআলা তাকে আরও সম্মান দান করেন। অধিকন্তু কারো অপরাধ ক্ষমা করলে সম্মানের কোনো হানী হয় না।’ (মুসনাদে আহমাদ)
হজরত আব্দুল্লাহ বিন আমর রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ‘যে দয়া প্রদর্শন করবে, রহমান প্রভু তার প্রতি দয়া করবেন। তোমরা পৃথিবীবাসীর প্রতি দয়া কর, তাহলে উর্ধ্বালোকবাসীরা তোমাদের প্রতি দয়া করবেন।’ (আবু দাউদ)
সৃষ্টির প্রতি দয়া প্রদর্শনে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের বেশ কয়েকটি হাদিস তুলা হলো। এখন আমাদের ভাবতে হবে, যে বিষয়ে এত বেশি জোর তাগিদ দেয়া হয়েছে, সে বিষয়ে আমরা কেন এত উদাসিন?
তাই আসুন, আমরা একে অপরের প্রতি দয়াশীল হই। আমরা যদি অন্যের প্রতি সহানুভূতি প্রদর্শন করি তাহলে আল্লাহ তাআলাও আমাদের প্রতি দয়া প্রদর্শন করবেন বলেও জানিয়েছেন বিশ্বনবি। তিনি বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি বান্দার প্রতি দয়া করে না, আল্লাহ তাআলা ওই বান্দার প্রতি দয়া করনে না।’
আল্লাহ তাআলা আমাদের সবাইকে প্রকৃত ইসলামের শিক্ষা অনুসরণ করে জীবন পরিচালনার তাওফিক দান করুন। পরস্পর মুসলিম ভ্রাতৃত্ব বজায় রাখার তাওফিক দান করুন। হাদিসের ওপর যথাযথ আমল করার তাওফিক দান করুন। আমিন। লেখক – মাহমুদ আহমদ , ইসলামি গবেষক ও কলামিস্ট।