করোনা ও বৃষ্টি নিয়ে শুরু দুর্গাপূজা
ঢাকা: করোনার প্রাদুর্ভাবের পাশাপাশি বৃষ্টিস্নাত পরিবেশে শুরু হলো দুর্গাপূজা। বৃহস্পতিবার ষষ্ঠীপূজার মধ্য দিয়ে সূচনা ঘটেছে হিন্দু সম্প্রদায়ের সবচেয়ে বড় এই ধর্মীয় অনুষ্ঠানের। এদিন দুর্গতিনাশিনী দেবীর অধিষ্ঠান, আমন্ত্রণ ও অধিবাসের মধ্য দিয়ে শুরু হয়েছে পাঁচ দিনের দুর্গাপূজার মূল আনুষ্ঠানিকতা।
অবশ্য বৈশ্বিক মহামারি করোনাভাইরাসের কারণে বেশ আগেই সারাদেশে উৎসব ছাড়াই এবারের দুর্গাপূজা আয়োজনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। এই সিদ্ধান্তের ভিত্তিতে আলোকসজ্জা, সাজসজ্জাসহ উৎসব সংশ্নিষ্ট বিষয়গুলো পরিহার করে স্বাস্থ্যবিধি মেনে এবারের পূজাকে সাত্ত্বিক পূজায় সীমাবদ্ধ রাখা হয়েছে। সন্ধ্যাআরতির পর সব পূজামণ্ডপ ও মন্দির বন্ধ রাখার সিদ্ধান্তও নেওয়া হয়েছে। তাই এবারের দুর্গোৎসবকে কেবল দুর্গাপূজা হিসেবে অভিহিত করা হচ্ছে।
আবার এ বছরের দুর্গোৎসব শুরুর মাস আশ্বিন ‘মল মাস’ তথা ‘অশুভ মাস’ হিসেবে বিবেচিত হওয়ায় হেমন্ত ঋতুর কার্তিক মাসে এই পূজার আয়োজন হচ্ছে। কারণ মল মাসে পূজা-অর্চনা কিংবা ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠানের আয়োজন হয় না। একই কারণে প্রতি বছর মহালয়া তথা দেবীপক্ষ শুরুর সাত দিন পর পাঁচ দিনের দুর্গোৎসবের আনুষ্ঠানিক সূচনা ঘটলেও এবার ব্যতিক্রম ঘটছে। গত ১৭ সেপ্টেম্বর মহালয়া আয়োজিত হলেও এবারে দুর্গাপূজা শুরু হচ্ছে দেবীপক্ষের সূচনার ৩৫ দিন পার করে। করোনার প্রাদুর্ভাব আর কার্তিকে পূজার আয়োজনের কারণেও এবার শারদীয় দুর্গোৎসবের সেই চিরচেনা আনন্দমুখর পরিবেশ অনেকটাই অনুপস্থিত রয়েছে।
এই অবস্থায় আড়ম্বর ও উৎসব ছাড়াই গতকাল শুরু হয় দুর্গাপূজার আয়োজন। এদিন সকাল থেকে দেশের বিভিন্ন স্থানে মুষলধারে বৃষ্টি শুরু হওয়ায় পূজার আনন্দে আরও ভাটা পড়ে। পূজারি আর ভক্ত-দর্শনার্থীরা তেমন একটা বের হতেও পারেননি ঘর থেকে। কোনো কোনো জায়গায় অবশ্য বৃষ্টি না থাকায় ম প-মন্দিরে দর্শনার্থীর উপস্থিতি দেখা গেছে। তবে সরকারের নির্দেশনা অনুযায়ী কোথাও একসঙ্গে ৪৫ জনের বেশি দর্শনার্থীর প্রবেশের অনুমতি ছিল না। সে ক্ষেত্রেও স্বাস্থ্যবিধি মেনে মাস্ক পরে নারী-পুরুষকে আলাদা সারিতে দাঁড়িয়ে পূজামণ্ডপে যেতে হয়েছে।
পাঁচ দিনের দুর্গোৎসবের প্রথম দিনে গতকাল ষষ্ঠীতিথিতে ম পে ম পে দেবীর অধিষ্ঠান হয়। সকাল ৯টা ৫৭ মিনিটের মধ্যে ছিল ষষ্ঠ্যাদি কল্পারম্ভ ও ষষ্ঠীবিহিত পূজা। এ সময় বেলতলা কিংবা বেলগাছের নিচে দেওয়া হয় ষষ্ঠীপূজা। সন্ধ্যায় দেবীর আমন্ত্রণ ও অধিবাস ছাড়াও সব মণ্ডপে পুষ্পাঞ্জলি ও ভোগ-আরতির আয়োজন করা হয়।
উৎসবের দ্বিতীয় দিনে আজ শুক্রবার হবে মহাসপ্তমী। সকালে ত্রিনয়নী দেবীদুর্গার চক্ষুদান করা হবে। এরপর সকাল ৯টা ৫৭ মিনিটের মধ্যে দেবীর নবপত্রিকা প্রবেশ, স্থাপন, সপ্তম্যাদি কল্পারম্ভ ও সপ্তমীবিহিত পূজা অনুষ্ঠিত হবে। এভাবে উৎসব চলবে আগামী সোমবার বিজয়া দশমীতে প্রতিমা বিসর্জন পর্যন্ত।
ঢাকা মহানগরীর ২৩১টিসহ সারাদেশের ৩০ হাজার ২৩১টি পূজাম পে গতকাল দুর্গাপূজা শুরু হয়। হিন্দুদের পাশাপাশি অন্য ধর্মের মানুষও যোগ দেওয়ায় পূজা সর্বজনীন রূপ পায়। উৎসবের আমেজ না থাকলেও সারাদেশের মণ্ডপে মণ্ডপে ঢাকের বাদ্য, শঙ্খ আর উলুধ্বনির শব্দ জানান দিচ্ছে, দেবী দুর্গার মর্ত্যে আগমন ঘটেছে।
কেন্দ্রীয় পূজা উৎসব বলে পরিচিত ঢাকেশ্বরী জাতীয় মন্দির মেলাঙ্গনের ম পের সামনে প্যান্ডেল ছাড়াও মন্দিরকে সাজানো হয়েছে নতুন রঙ, সাজ ও আলোকসজ্জায়। এখানে পুলিশের বিশেষ কন্ট্রোল রুমের পাশাপাশি পূজা উদযাপন পরিষদ কেন্দ্রীয় নিয়ন্ত্রণ কক্ষ স্থাপন করেছে। বসানো হয়েছে ক্লোজ সার্কিট ক্যামেরা। সকাল ও সন্ধ্যায় ষষ্ঠীপূজার নানা আনুষ্ঠানিকতার পাশাপাশি পূজা শেষে অঞ্জলি ও ভোগ-আরতি ছিল উৎসবের অন্যতম অনুষঙ্গ।
রাজধানীর গোপীবাগের রামকৃষ্ণ মিশন ও মঠ, রমনা কালীমন্দির ও মা আনন্দময়ী আশ্রম, রাজারবাগের বরোদেশ্বরী কালীমাতা মন্দির ও শ্মশান, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জগন্নাথ হল এবং বনানীতে গুলশান-বনানী সার্বজনীন পূজামণ্ডপে দুর্গাপূজার আনুষ্ঠানিকতা শুরু হয়েছে। এ ছাড়া মিরপুর কেন্দ্রীয় মন্দির, সিদ্ধেশ্বরী কালীমন্দির, শাঁখারীবাজারের প্রতিদ্বন্দ্বী পূজামণ্ডপ, পান্নিটোলা, জয়কালী রোডের রামসীতা মন্দির, অভয়নগর দাস লেনের ভোলানন্দগিরি আশ্রম, রাধিকা বসাক লেন, নবেন্দ্র বসাক লেন, ঢাকেশ্বরীবাড়ী, টিকাটুলীর প্রণব মঠ, ঠাঁটারীবাজার পঞ্চানন শিব মন্দির, সূত্রাপুরের ঋষিপাড়া গৌতম মন্দির, বনগ্রাম তরুণ সংসদ, উত্তর মৌশুন্দী, ফরাশগঞ্জ জমিদারবাড়ী এবং বিহারীলাল জিও মন্দিরসহ বিভিন্ন মন্দির ও ম পে দুর্গাপূজা শুরু হয়েছে।
নিশ্ছিদ্র নিরাপত্তাব্যবস্থা : দুর্গাপূজাকে ঘিরে কঠোর নিরাপত্তা ব্যবস্থা ছিল সারাদেশে। প্রতিটি মণ্ডপে পুলিশ, আনসার-ভিডিপির পাশাপাশি কোথাও কোথাও নিযুক্ত করা হয় র্যাব সদস্যদের। সাদা পোশাকে গোয়েন্দা সদস্যদের ছিল সতর্ক প্রহরা। অনেক মণ্ডপে আর্চওয়ে ও মেটাল ডিটেক্টরে কড়া তল্লাশির মধ্য দিয়ে মণ্ডপে প্রবেশ করতে হয়েছে দর্শনার্থীদের।
বৃহস্পতিবার রাজধানীর বনানীর পূজাম পে সার্বিক নিরাপত্তা পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করেছেন র্যাবের মহাপরিচালক চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুন। পরে তিনি সাংবাদিকদের জানান, দুর্গাপূজা উপলক্ষে ঢাকাসহ সারাদেশে র্যাব নিশ্ছিদ্র নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিয়েছে। নাশকতার আশঙ্কা না থাকলেও যে কোনো পরিস্থিতি মোকাবিলায় র্যাব সদস্যরা প্রস্তুত রয়েছেন। সাদা পোশাকে র্যাব গোয়েন্দারা কাজ করছেন। বোম্ব্ব ডিসপোজাল ইউনিট, ডগ স্কোয়াড এবং সুইপিং টিমও প্রস্তুত রাখা হয়েছে।
করোনার কারণে পূজারি-দর্শনার্থীরা স্বাস্থ্যবিধি মেনে সতর্কতার সঙ্গে পূজা অনুষ্ঠানে যোগ দেবেন বলে আশা প্রকাশ করে র্যাবপ্রধান বলেন, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে পূজাকেন্দ্রিক যে কোনো গুজব এবং পূজাম পে নারী দর্শনার্থীদের ইভটিজিং রোধেও ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে।