জিনিয়া অপহরণ, রিমান্ডে জিজ্ঞাসাবাদে যা বললেন লুপা তালুকদার

281

ঢাকা: ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষক কেন্দ্র (টিএসসি) এলাকা থেকে ফুল বিক্রেতা শিশু জিনিয়াকে (৯) পাচারের উদ্দেশ্যেই অপহরণ করা হয়েছিল বলে ধারণা করছে ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) গোয়েন্দা শাখা (ডিবি)। তবে রিমান্ডে জিজ্ঞাসাবাদে লুপা তালুকদার দাবি করেছেন, ভূত তাড়াতে জিনিয়াকে নিয়ে গিয়েছিলেন। ডিবির রমনা জোনাল টিমের তদন্তসংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা গতকাল শুক্রবার এসব তথ্য জানান। এদিকে জিনিয়া অপহরণ মামলায় গ্রেপ্তার লুপাকে দুদিনের রিমান্ড শেষে গতকাল কারাগারে পাঠানো হয়েছে।  তদন্তসংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান, লুপা তালুকদারের অতীত রেকর্ড ভালো নয়। নানা ধরনের অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে তার জড়িত থাকার তথ্য পাওয়া গেছে। যদিও তিনি অপহৃত শিশু জিনিয়াকে পাচার করার কথা অস্বীকার করেছেন। তার দাবি, তার ১৯ বছর বয়সী মেয়ে নদীর সঙ্গে জিন-ভূত আছে। কালীমন্দিরে গিয়ে তার মেয়ের ভূত তাড়ানোর জন্যই মেয়েটিকে নিয়ে গিয়েছিলেন তিনি।

ডিবির একাধিক কর্মকর্তা বলেন, জিনিয়া অপহরণের পেছনে লুপা তালুকদারের দেওয়া বক্তব্য বিশ্বাসযোগ্য নয়। তার যে খারাপ মতলব ছিল সে বিষয়ে নিশ্চিত হওয়া গেছে।

জিনিয়া অপহরণের ঘটনায় গত সোমবার মধ্যরাতে নারায়ণগঞ্জের ফতুল্লা এলাকা থেকে নাজনীন আক্তার ওরফে লুপা বেগম ওরফে লুপা তালুকদারকে গ্রেপ্তার করে ডিবির রমনা জোনাল টিম। জিনিয়া

টিএসসি এলাকায় ফুল বিক্রি করে এবং মা সেনুয়া বেগমের সঙ্গে ওই এলাকাতেই থাকে। জিনিয়া নিখোঁজ হওয়ার পরদিন গত ২ সেপ্টেম্বর শাহবাগ থানায় একটি জিডি করেন তার মা।

ডিবির তদন্ত, সিসিটিভি ফুটেজ বিশ্লেষণ ও প্রত্যক্ষদর্শীদের ভাষ্য মতে, দুজন নারী ফুচকা খাওয়ায় জিনিয়াকে। টিএসসি এলাকায় তাকে নিয়ে ঘোরাফেরা করে। একপর্যায়ে কৌশলে তাকে বাসায় নিয়ে যায়। এ ঘটনায় সোমবার শাহবাগ থানায় অপহরণ মামলা হয়।

ডিবির রমনা জোনাল টিমের অতিরিক্ত উপকমিশনার মিশু বিশ্বাস গতকাল বলেন, ‘লুপাকে দুই দিনের রিমান্ডে জিজ্ঞাসাবাদ শেষে আদালতের মাধ্যমে কারাগারে পাঠানো হয়েছে। জিজ্ঞাসাবাদে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পাওয়া গেছে। এছাড়া জিনিয়ার ২২ ধারায় রেকর্ডকৃত বক্তব্যও গ্রহণ করা হয়েছে। সব তথ্য বিশ্লেষণ করে আমাদের কাছে মনে হয়েছে, জিনিয়াকে খারাপ কাজে ব্যবহারের উদ্দেশ্যেই লুপা ও তার কন্যা মিলে অপহরণ করেছিলেন।’

তদন্তসংশ্লিষ্ট একাধিক কর্মকর্তা জানান, লুপা তালুকদার ও তার মেয়ে দুজনেই মাদকাসক্ত। এ বিষয়ে জানতে চাইলে জিজ্ঞাসাবাদে লুপা তালুকদার দাবি করেছেন, তার ১৯ বছর বয়সী নদীর ওপর ভূতের আছর পড়েছে। আগুন ছাড়া থাকলেই জিন-ভূত ভর করে। এজন্য সবসময়ই তার হাতে সিগারেট কিংবা গাঁজার বিড়ি থাকত। তিনিও বসতঘর জিন-ভূত মুক্ত রাখার জন্য নেশা করতেন। এছাড়া জিনিয়াকে দত্তক নেওয়ার দাবি করলেও তার সপক্ষে কোনো তথ্যপ্রমাণ দিতে পারেননি লুপা। তার ভাষ্য, নদীর সঙ্গে থাকা জিন-ভূত তাড়ানোর জন্যই জিনিয়াকে নিয়েছিলেন।

কর্মকর্তারা জানান, জিনিয়া অপহরণের পেছনে লুপা ও তার মেয়ে নদীর অসৎ উদ্দেশ্য ছিল। কারণ মেয়েটিকে নিয়ে তারা উঠেছিল রাজধানীর প্রেস ক্লাব সংলগ্ন নিউ ইয়র্ক হোটেলে। সেখানে ২৮ আগস্ট থেকে ১ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত অবস্থান করেন তারা। তারপর সেখান থেকে নারায়ণগঞ্জের ফতুল্লায় নিয়ে যান। সেখানে গিয়ে জিনিয়ার নাম বদলে ফেলেন। হোটেলে ওঠার কারণ জানতে চাইলে লুপা গোয়েন্দা কর্মকর্তাদের কাছে দাবি করেন, ২৮ সেপ্টেম্বর তার দ্বিতীয় স্বামী সেবুল আহমেদ কাতার থেকে ফিরবেন এজন্যই হোটেলে উঠেছিলেন। জিজ্ঞাসাবাদকারী আরেক কর্মকর্তা জানান, মেয়েটিকে পাচার করার মতলব ছিল তাদের। এজন্যই তার নাম বদলে পরিচয় গোপনের চেষ্টা করেছিলেন।

এসব বিষয়ে জানতে চাইলে ডিবির রমনা জোনাল টিমের উপকমিশনার মো. আজিমুল হক বলেন, ‘দুদিনের রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদকালে লুপা তালুকদারকে খুবই ধূর্ত প্রকৃতির মনে হয়েছে। কোনো প্রশ্নেরই সঠিক উত্তর দেননি। একেক সময় একেক ধরনের উত্তর দিয়েছেন। যেগুলোর সঙ্গে অপহরণ ঘটনার কোনো মিল পাওয়া যায়নি। কখনো বলেছেন, তার মেয়ের ভূত তাড়ানোর কাজে ব্যবহারের জন্য জিনিয়াকে নিয়েছিলেন। কখনো বলেছেন, দত্তক নেওয়ার জন্য। যদিও এসব বিষয়ে কোনো তথ্যপ্রমাণ দিতে পারেননি। লুপা তালুকদারের বিরুদ্ধে প্রতারণার অভিযোগে একাধিক জিডির কপি আমাদের হাতে এসেছে। সেসব বিশ্লেষণ করে জানা গেছে, তিনি সাংবাদিকতার পরিচয় দিয়ে বিভিন্ন মানুষের কাছ থেকে লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন।

তিনি আরও  বলেন, ‘জিনিয়া অপহরণের কারণ বিষয়ে বরাবরই লুপা এলোমেলো তথ্য দিয়েছেন। কোনো সঠিক উত্তর পাওয়া যায়নি। কাজেই বিষয়টি দীর্ঘ তদন্তের দাবি রাখে।’

পটুয়াখালীর গলাচিপা উপজেলার গোলকালী গ্রামের একাধিক বাসিন্দা জানান, স্কুলজীবন থেকেই লুপা ছিলেন উচ্ছৃঙ্খল প্রকৃতির। নকলের সহায়তায় টেনেটুনে এসএসসি পাস করলেও আর এগোতে পারেননি। তখন থেকেই মাদকসেবন ও ব্যবসার সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন। বহুবিবাহ ও বিচ্ছেদে অভ্যস্ত হয়ে পড়েন। বাড়ির কাজের মেয়ে শাহিনুরের ওপর লুপার স্বামীর যৌন নিপীড়নের ঘটনা ফাঁস হয়ে পড়লে লুপা ও তার পরিবারের সদস্যরা ক্ষিপ্ত হয়ে শাহিনুর ও তার শিশুকন্যাকে শ্বাসরোধে হত্যার পর নদীতে ফেলে দেয়। এ ঘটনায় মামলা হলে লুপা তালুকদার, তার বাবা হাবিবুর রহমান নান্না মিয়া তালুকদার, দুই ভাই লিকন, লিটন, স্বামীসহ ১১ জন আসামি অভিযুক্ত হন। পরে নিজেদের আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে জড়িত থাকার প্রচার চালিয়ে রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে ওই মামলা থেকে অব্যাহতি নেন।

সংশ্লিষ্টরা জানান, ওই হত্যা মামলা চলাকালে আদালতের বাথরুমে স্ট্রোক করে মারা যান লুপার বাবা নান্না তালুকদার। তার ভাই লিটন তালুকদার নেশাগ্রস্ত হয়ে মারা যান। বর্তমানে লুপার ভাই লিকন তালুকদার পারিবারিক বিশাল ভূসম্পত্তির মালিক। একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে তাদের পরিবারের তিন সদস্য ছিলেন শান্তি কমিটির সদস্য। তখন মুক্তিযোদ্ধাদের বাড়ি দখলের পাশাপাশি বিভিন্ন চর দখল করে তারা বিপুল ভূসম্পত্তির মালিক বনে যান। বহুবিবাহ ও মাদকাসক্ত হওয়ার কারণে পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে লুপার তেমন যোগাযোগ নেই।  সূত্র : দেশ রূপান্তর

Leave A Reply

Your email address will not be published.