রিভার্স সুইং : ক্রিকেট বিশ্বের ব্ল্যাক ম্যাজিক

217

স্পোর্টস ডেস্ক : করোনাভাইরাল মহামারির কারণে মুখের লালা দিয়ে ক্রিকেট বল পালিশ করার ওপর আইসিসি যে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে – কিছু দিন আগে তা ভাঙার অভিযোগে প্রথম অভিযুক্ত হন একজন ইংলিশ বোলার – তার নাম ডম সিবলি।

ঘটনাটি ঘটে ইংল্যান্ড আর ওয়েস্ট ইন্ডিজের মধ্যেকার দ্বিতীয় টেস্টের চতুর্থ দিনে।

সিবলি তখন ফিল্ডিং করছিলেন। বল হাতে পাবার পর তিনি ভুলবশত: তা পালিশ করার জন্য তার মুখের লালা ব্যবহার করেন।

অবশ্য একটু পরই তার ভুল বুঝতে পারেন তিনি।

তখন ইংল্যান্ড দল ব্যাপারটা আম্পায়ারকে জানায়, এবং আম্পায়ার সাথে সাথেই বলটি জীবাণুমুক্ত করেন।

করোনাভাইরাস সংক্রমণ ঠেকানোর জন্য আইসিসি থুথু দিয়ে ক্রিকেট বল পালিশ করার ওপর সাময়িক নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছিল।

খেলোয়াড়রা এটা মেনেই চলছিলেন, কিন্তু অনিচ্ছাসত্বেও এ ঘটনা ঘটে যেতে পারে। কারণ ক্রিকেটাররা বছরের পর বছর ধরেই এটা করে আসছেন, এবং এটা তাদের অভ্যাসে পরিণত হয়ে গেছে।

তাই ক্রিকেট মাঠে দেখা যায়, বলটা কোন ফিল্ডার বা বোলারের হাতে গেলেই তারা এটাতে থুথু লাগিয়ে পালিশ করছেন এবং তার পর বোলার বা উইকেট কিপারের হাতে তা ফেরত দিচ্ছেন।

কেন এটা করা হয়?

মুখের লালা লাগিয়ে বলটাকে পালিশ করার উদ্দেশ্য হচ্ছে ক্রিকেট বলটাকে চকচকে রাখা – যাতে এটা সুইং করে অর্থাৎ বাতাসে বাঁক খায়।

এই সুইংএরই একটা বিশেষ প্রকারকে বলা হয় ‘রিভার্স সুইং’।

ক্রীড়া বিশেষজ্ঞ এবং ভক্তরা এই রিভার্স সুইংকে বলেন ক্রিকেটের এক ‘ডার্ক আর্ট‌’ বা গোপন বিদ্যা।

রিভার্স সুইং করানোর জন্য ক্রিকেটাররা যা করেন তা হলো, মুখের লালা দিয়ে বলটার একটা পাশ চকচকে এবং অপেক্ষাকৃত ভারি রাখা। অনেক ওভার ধরে এটা করতে থাকলে বলটার এক পাশ রুক্ষ বা খসখসে হয়ে যায়, অন্য পাশটা থাকে মসৃণ ।

এটা যে বলের স্বাভাবিক সুইংএ সহায়তা করে তাই নয়, খেলার শেষ ওভারগুলোতে বলটা রিভার্স (উল্টো দিকে) সুইং করানো বা দেরিতে সুইং করানোর ক্ষেত্রেও সহায়ক হয়।

একজন অফস্পিন বোলারের জন্য ‘দুসরা’ বলটাকে উল্টো দিকে টার্ণ করানো যেমন খুব কঠিন কাজ, ঠিক তেমনি একজন ফাস্ট বোলারের জন্য বলকে রিভার্স সুইং করানোও ক্রিকেটের সবচেয়ে কঠিন কাজগুলোর একটা।

ক্রিকেট বলকে স্বাভাবিক সুইং, লেট সুইং, বা রিভার্স সুইং – এর যে কোনোটা করানোর ব্যাপারটা নির্ভর করে বলটাকে বোলার কিভাবে ধরেছেন এবং তখন বলের মাঝখানের সেলাইগুলো কি অবস্থানে আছে – তার ওপর।

আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো বলটার এক পাশ রুক্ষ এবং আরেক পাশ মসৃণ বা চকচকে আছে কিনা।

বলে এক পাশ রুক্ষ করার জন্য অনেক সময়ই ক্রিকেটাররা এমন সব চেষ্টা করেন – যা খেলার আইনবিরুদ্ধ । তারা দীর্ঘ সময় ধরে বলের এক পাশ চকচকে রাখার চেষ্টার পরিবর্তে যদি তড়িঘড়ি করে অন্য পাশটাকে ইচ্ছে করে রুক্ষ করার চেষ্টা করেন – তাকে বলা হয় ‘বল ট্যাম্পারিং’ ।

পাকিস্তানের বোলার শাহিদ আফ্রিদি মুখ দিয়ে বলের সেলাই নষ্ট করার চেষ্টা করে বল ট্যাম্পারিংএর দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছিলেন।

পাকিস্তানীদের ঘামে কি বিশেষ কিছু আছে?

মুখের লালা দিয়ে পালিশ করা বল সুইং করায় পাকিস্তানের দুই বোলার এতই পারদর্শী হয়েছিলেন যে তা ১৯৮০ আর ৯০ এর দশকে ব্যাটসম্যানদের আতংকের মধ্যে রেখেছিলেন।

এরা হলেন ওয়াসিম আকরাম আর ওয়াকার ইউনুস।

তারা রিভার্স সুইংএর এ কৌশল সযত্নে গোপন রেখেছিলেন। আর যেহেতু দুজনেই জোরে বল করতেন এবং নানাভাবে বলকে সুইং করাতে পারতেন – তাই এর ফায়দা তুলেছিলেন পুরোপুরি।

সে জন্য তাদের কেরিয়ারের শেষ দিকে ওযাসিম আকরাম আর ওয়াকার ইউনুস দু’জনেই তাদের রান-আপের সময় কিভাবে বলটাকে ধরেছেন তা লুকিয়ে রাখতেন।

তাদের বোলিং বোঝার জন্য ব্যাটসম্যানরা তাদের ভিডিও বিশ্লেষণ করে কিভাবে তারা বল গ্রিপ করেছেন তা বের করার চেষ্টা করেছেন কিন্তু সফল হননি।

তারা যখন ৯০ মাইল গতিতে পুরোনো বল দিয়েও রিভার্স সুইং করাতে শুরু করলেন – তখন ইংলিশ আর অস্ট্রেলিয়ান বিশেষজ্ঞরা ওয়াসিম আকরামের বিরুদ্ধে বল ট্যাম্পারিংএর অভিযোগও এনেছিলেন কিন্তু তা কখনো প্রমাণিত হয়নি।

সে সময় পাকিস্তান দলের সবার দায়িত্ব ছিল তাদের ঘাম এবং লালা দিয়ে বলের এক পাশ চকচকে রাখা – যাতে ওয়াসিম আর ওয়াকার রিভার্স সুইং করাতে পারেন।

রিভার্স সুইংএর আবিষ্কারক বলে মানা হয় পাকিস্তানের আরেক ফাস্ট বোলার সরফরাজ নওয়াজকে। কিন্তু এই কৌশলের সবচেয়ে বিধ্বংসী প্রয়োগ দেখিয়েছিলেন ওয়াসিম আকরাম আর ওয়াকার ইউনুস।

ব্রিটিশ ক্রিকেট সাংবাদিক মার্টিন জনসন ১৯৯২ সালের পাকিস্তান সফরের পর দি ইনডিপেন্ডেন্ট পত্রিকায় লিখেছিলেন, “ওয়াসিম আর ওয়াকারের মত আর কোন ফাস্ট বোলারই পুরোনো বল দিয়ে এত সুইং করাতে পারেন না। হয়তো পাকিস্তানিদের ঘামের কোন বিশেষ ব্যাপার আছে।”

কিন্তু রিভার্স সুইংএর গোপন রহস্য খুব বেশি দিন গোপন থাকেনি। এর কৌশল বুঝে ফেলার পর সব বোলারই এখন এটা প্রয়োগ করার চেষ্টা করে থাকেন।

সে জন্যই আধুনিক ক্রিকেটে বল পালিশ করা এত বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে।

দেখা গেছে , অনেক খেলোয়াড় যখন বলের ওপর থুথু মাখাচ্ছেন তখন তাদের মুখে একটা মিষ্টি গাম জাতীয় কিছু থাকে। আইসিসির নিয়ম অনুযায়ী এধরণের কোন কিছু দিয়ে বল পালিশ করা ক্রিকেটের নিয়মের লঙ্ঘন। কারণ সেই মিষ্টিতে এমন কিছু উপাদান থাকে যা বলের চামড়াতে শোষিত হয়ে যায়, এবং তাকে ভারি করে তোলে।

ইংল্যান্ড – যেখানে সবুজ এবং দ্রুতগতির উইকেট তৈরি হয় – সেখানে স্কুল ও বিশ্ববিদ্যালয় স্তরের ক্রিকেটেও খেলোয়াড়দের শুরু থেকেই বল পালিশ করা শেখানো হয় – যাতে এটা তাদের অভ্যাসে পরিণত হয়ে যায়।

আমি নিজে যখন শেফিল্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় ক্রিকেট খেলেছি, তখন দেখেছি কোচরা প্র্যাকটিস ম্যাচের সময় ফিল্ডারদের জোর উপদেশ দিতেন যেন অপ্রয়োজনে বলটা মাটিতে আঘাত না খায়, এবং কোন ফিল্ডারের হাতে বল গেলেই সে যেন বলটি ‘শাইন‌’ করে ফেরত দেয়। একজন কোচ ব্যাপারটাকে এতই গুরুত্ব দিতেন যে কেউ এটা না করলে তাকে মাঠ থেকে বের করে দিতেন।

এ ব্যাপারে বিজ্ঞান কী বলে?

যুক্তরাজ্যের বাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগে এ নিয়ে এক গবেষণা হয়েছে।

এর গবেষকরা ৯টি ভিন্ন ভিন্ন ধরণের বল পরীক্ষা করেছেন – নতুন থেকে ৮০ ওভার পুরোনো অবস্থা পর্যন্ত। আন্তর্জাতিক ম্যাচে যে দুটি কোম্পানি বল সরবরাহ করে সেই ডিউক্স এবং কোকাবুরা – দু ধরণের বলই এতে ব্যবহৃত হয়।

জরিপে দেখা যায় যে ২৫ ওভারের পুরোনো একটি বল দিয়ে স্বাভাবিক অবস্থায় সর্বোচ্চ ঘন্টায় ৭৫ মাইল গতিতে বোলিং করা হলে তা সুইং করবে। কিন্তু যদি ক্রিকেটারের মুখে মিষ্টি কিছু থাকে এবং সেই লালা বলের একাংশে লাগানো হয় – তাহলে সেই বল সুইং করবে যদি ৯০ মাইলের বেশি গতিতে বোলিং করা হয়।

জরিপে আরো বলা হয়, বলটা স্বাভাবিক অবস্থায় থাকবে সুইংএর পরিমাণ হবে সামান্য। কিন্তু তা রিভার্স সুইং করবে শুধু তখনই – যদি তা দিয়ে ঘন্টায় ৯৫ মাইল বা তার চেয়ে বেশি গতিতে বোলিং করা হয়।

এই কারণেই শোয়েব আখতার, ব্রেট লি বা ডেল স্টাইনের মত বোলার – যারা প্রচন্ড গতিতে বোলিং করতেন – তারা প্রথম দিকের ওভারগুলোয় এত বিপজ্জনক হয়ে উঠতেন।

তবে ক্রিকেটের দুনিয়ায় এখন এত পরিবর্তন হচ্ছে যে – যদিও অনেক বোলারই এখন রিভার্স সুইং করাতে পারেন, কিন্তু তবুও এটা দেখতে হলে আপনাকে হয়তো অতীতের খেলার ভিডিও দেখতে হবে।

এখন ক্রিকেট খেলা হচ্ছে ২০ ওভারের বা ১২০ বলের। এর মধ্যে নতুন ফরম্যাটও আসছে, যাকে বলা হচ্ছে হান্ড্রেডস – যাতে প্রতিটি ইনিংস হবে ১০ ওভারের , আর প্রতি ওভারে থাকবে ১০ বল।

এ অবস্থায় অদূর ভবিষ্যতে বোলারদের পক্ষে রিভার্স সুইং করানো অনেক কঠিন হয়ে যাবে।

বলের ক্ষেত্রে ক্রিকেটের নিয়ম পাল্টানো হয়তো সম্ভব হবে না। কিন্তু আধুনিক খেলার জগতে টিকে থাকার জন্য ক্রিকেটকে হয়তো তার আসল সৌন্দর্যের কিছু উপাদানকে ত্যাগ করতে হবে।

তখন রিভার্স সুইংএর মতো বোলিংএর শৈল্পিক দিকগুলোর ঠাঁই হবে হয়তো শুধু ইতিহাসের পাতায়।

Leave A Reply

Your email address will not be published.