সরকার গঠনের প্রস্তুতি মোদির শপথ ৩০ মে
সপ্তদশ লোকসভা নির্বাচনে বিপুল বিজয়ের পর প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি দ্বিতীয় দফা সরকার গঠনের প্রস্তুতি নিতে শুরু করেছেন। ইতিমধ্যে তিনি বিদায়ী মন্ত্রিসভার সদস্যদের নিয়ে বৈঠকও করেছেন। আগামী ৩০ মে তিনি দ্বিতীয়বারের মতো প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ নিতে যাচ্ছেন।
অপরদিকে বিজেপি জোটের কাছে ধরাশায়ী হওয়ার পর কংগ্রেস জোটে দেখা দিয়েছে চরম হতাশা। দল ও জোটের শোচনীয় পরাজয়ে কংগ্রেস সভাপতি রাহুল গান্ধী দলীয় প্রধানের পদ থেকে পদত্যাগের ঘোষণা দিয়েছেন। রাজ্যে রাজ্যে কংগ্রেসের নেতাকর্মীদের মধ্যেও হতাশা পেয়ে বসেছে। দলের প্রতি অনাস্থা জানিয়ে অনেক প্রভাবশালী নেতা পদত্যাগও করেছেন।
বিজেপির বিশাল জয়ের একদিন পর নরেন্দ্র মোদি শুক্রবার সকালে দলের দুই বর্ষীয়ান নেতা লালকৃষ্ণ আদভানি এবং মুরলি মনোহর যোশির সঙ্গে দেখা করে তাদের আশীর্বাদ নিয়েছেন। আদভানির পা ছুঁয়ে মোদি আশীর্বাদ নেন। এ সময় তার সঙ্গে বিজেপি সভাপতি অমিত শাহ ছিলেন। খবর আনন্দবাজার পত্রিকা, পিটিআই ও এনডিটিভির।
লোকসভা নির্বাচনের চূড়ান্ত ফলাফলে বিজেপি ৩০৩টি আসন পেয়েছে। যা এককভাবে সরকার গঠন করার মতো আসন (২৭২) থেকে অনেক বেশি। বিজেপি নেতৃত্বাধীন এনডিএ জোট পেয়েছে ৩৫১টি আসন। অপরদিকে কংগ্রেস এককভাবে পেয়েছে মাত্র ৫২টি আসন। কংগ্রেস নেতৃত্বাধীন ইউপিএ জোট পেয়েছে মাত্র ৯২টি আসন।
নরেন্দ্র মোদি দ্বিতীয় মেয়াদে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে আগামী ৩০ মে শপথ নিতে যাচ্ছেন। ওইদিন বিকালে তিনি ভারতের ১৮তম প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ নেবেন। শপথ নেয়ার আগে তিনি রাষ্ট্রপতি রামনাথ কোবিন্দের কাছে নতুন সরকার গঠনের দাবি পেশ করবেন।
বৃহস্পতিবার ৪টা থেকে ৫টার মধ্যে রাষ্ট্রপতি ভবনে তার শপথগ্রহণ অনুষ্ঠান হতে পারে। তবে একইদিন মন্ত্রিসভা শপথগ্রহণ করবে কিনা তা অবশ্য পরিষ্কার নয়।
এর আগে ২০১৪ সালের নির্বাচনে জয়লাভের পর দেশের ১৭তম প্রধানমন্ত্রী হিসেবে মোদি শপথ নেন। ওই বছরের ২৬ মে (সোমবার) তৎকালীন রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখোপাধ্যায়ের কাছে প্রথমবারের মতো প্রধানমন্ত্রী হিসেবে তিনি শপথ নেন।
৩০ মে শপথগ্রহণের আগে ২৮ মে বারানসি ও গুজরাটে যেতে পারেন মোদি। মা হীরাবেনের আশীর্বাদ চাইতে তিনি গুজরাটে যেতে পারেন।
কংগ্রেসের ‘প্রিয়াংকা চমক’, ‘চৌকিদার চোর হ্যায়’ কোনো অস্ত্রই বিজেপিকে ঘায়েল করতে পারেনি। উল্টো গোটা ভারতেই কংগ্রেস ধরাশায়ী হয়েছে। এমনকি দলের সভাপতি রাহুল গান্ধী পর্যন্ত আমেথিতে হেরেছেন। হেরেছেন দলের শীর্ষনেতারাও। পরাজিতদের মধ্যে রয়েছেন কংগ্রেসের সাবেক আট মুখ্যমন্ত্রীও।
কার দোষে কংগ্রেসের এমন পরাজয় সেসবের চুলচেরা বিশ্লেষণ চলছে। এবারের লোকসভা নির্বাচনে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির দল বিজেপিকে হারাতে একাট্টা হয়েছিল বিভিন্ন আঞ্চলিক দল, কংগ্রেস তো ছিলই। বিশেষ করে ভোটের প্রচারে রাহুল গান্ধী, পশ্চিমবঙ্গের তৃণমূল কংগ্রেসের নেত্রী মমতা ব্যানার্জি সঙ্গে মোদির কথার লড়াই বেশ জমে উঠেছিল। কিন্তু সব বাক্যবাণকে পেছনে ফেলে শেষতক মোদি ম্যাজিকেই বাজিমাত করেছে বিজেপি।
কংগ্রেস গতবারের তুলনায় আটটি আসন বেশি পেলেও নির্বাচনে ভরাডুবি আটকাতে পারেনি। ভারতের শতাব্দী প্রাচীন দলটি এবার ৫২ আসনে জিতেছে, গতবার তারা ৪৪ আসন পেয়েছিল। যা ছিল ভারতীয় উপমহাদেশের পুরনো এ দলের ইতিহাসে সবচেয়ে বাজে পরাজয়।
এবারের লোকসভা যুদ্ধে কংগ্রেসের সবচেয়ে বড় রণক্ষেত্র ছিল উত্তরপ্রদেশ। আর পদত্যাগের শুরুটাও হয়েছে সেখান থেকেই। হারের লজ্জা ঢাকতে পদত্যাগের এ তালিকা ক্রমেই বাড়ছে। ৮০ আসনের এ রাজ্যে কংগ্রেস দখলে রাখতে পেরেছে মাত্র একটি আসন।
এক সময় উত্তরপ্রদেশে রাজত্ব করা কংগ্রেস টিমটিম করে জ্বলছে শুধু গান্ধী পরিবারের আরেক খাসতালুক সোনিয়া গান্ধীর আসন রায়বেরিলি। শুধু উত্তরপ্রদেশ নয়, কর্নাটক ও ওড়িশা থেকেও কার্যত মুছে গেছে কংগ্রেস।
ওড়িশার বিধানসভা বা লোকসভা, কোনো নির্বাচনেই দাগ কাটতে পারেনি তারা। সেই দায় মাথায় নিয়ে ইতিমধ্যেই পদত্যাগ করেছেন ওড়িশার কংগ্রেস সভাপতি নিরঞ্জন পট্টনায়ক। পদত্যাগ করেছেন কর্নাটকে দলের প্রচারের দায়িত্ব থাকা এইচকে পাটিলও।
২০১৯-এর ফাইনাল যুদ্ধে মোদি সরকারকে হারানোর শপথ নিয়েছিল কংগ্রেস। ২০১৮ সালের পাঁচ রাজ্যে সেমিফাইনাল যুদ্ধে সেই আভাসও তুলে ধরতে সমর্থ হয়েছিলেন কংগ্রেস সভাপতি রাহুল গান্ধী। কিন্তু বিজেপিকে প্যাভিলিয়নে পাঠাতে গিয়ে ১৭ রাজ্য কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল থেকে নিশ্চিহ্ন হয়ে গেল কংগ্রেস। আন্দামান নিকোবরে একটি মাত্র লোকসভা কেন্দ্র। এই কেন্দ্র এবার বিজেপির দিকে ঢলে পড়েছে।
অন্ধ্রপ্রদেশের ২৫টি লোকসভা আসন। তার মধ্যে জগমোহন রেড্ডির ওয়াইএসআর কংগ্রেস পেয়েছে ২২টি আসন। তেলেগু দেশম পার্টির দখলে তিনটি আসন। কংগ্রেস শূন্য। অরুণাচল প্রদেশে মোট আসন দুটি। এ দুটি আসনই এবার দখল পেয়েছে বিজেপি। কংগ্রেস এখানে খাতা খুলতে পারেনি। চণ্ডীগড়ে একটি আসনও গেছে বিজেপির দখলে। ফলে কংগ্রেস এবারও খাতা খুলতে পারেনি।
দাদরা নগর হাভেলিতে একটি মাত্র আসন। এই আসনটিও বিজেপি দখল করল। এখানেও শূন্য হাত কংগ্রেসের। দমন-দিউয়ের কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলও এবার কংগ্রেসকে নিরাশ করল। একটি মাত্র কেন্দ্রে জয়ী হল কংগ্রেস। রাজধানী দিল্লি কংগ্রেসকে আরও একবার হতাশ করেছে। সাতটি আসনই জিতে ক্লিন সুইপ করেছে বিজেপি। কংগ্রেস বিগ জিরো।
মোদি-রাজ্য গুজরাটে এবারও কংগ্রেস শূন্য। হরিয়ানায় আবার ক্লিন সুইপ। ১০টি আসনেই কংগ্রেস ধূলিসাৎ। বিজেপি ১০ আসনেই জয়ী। হিমাচল প্রদেশের চারটি আসনে জয়ী হয়েছে বিজেপি। জম্মু ও কাশ্মীরে কংগ্রেস এবার খাতা খুলতে পারেনি। ছয়টি আসনের মধ্যে বিজেপি তিনটি ও ন্যাশনাল কনফারেন্স তিনটি আসনে জয়ী হয়েছে।
মণিপুরেও কংগ্রেস শূন্য। দুটির মধ্যে বিজেপি একটি, নাগা পিপলস পার্টি একটি। নাগাল্যান্ডে একটি মাত্র লোকসভা আসন। সেখানেও এবার খাতা খুলতে ব্যর্থ কংগ্রেস। এনডিপিপি এই কেন্দ্রটি দখল করেছে।
রাজস্থানে মোট ২৫টি আসন। রাজস্থানে কংগ্রেস ক্ষমতায় থাকা সত্ত্বেও একটি আসনও দখল করতে পারেনি দলটি। বিজেপি ২৪টি, রাষ্ট্রীয় লোকতান্ত্রিক পার্টি একটি আসন দখল করে। সিকিমে একটি মাত্র আসন। এখানেও কংগ্রেস জয়ী হতে পারেনি। সিকিম ক্রান্তিকারী মোর্চা এই আসনটি দখল করেছে।
ত্রিপুরায় দুটি আসনই এবার গেছে বিজেপির দখলে। উত্তরাখণ্ডে মোট পাঁচটি আসন। পাঁচটি আসনেই জয়ী হয়েছে বিজেপি।
এবার পশ্চিমবঙ্গের অল ইন্ডিয়া তৃণমূল কংগ্রেস ২২টি আসনে জয়লাভ করেছে। এনডিএ জোটের দল শিবসেনা ১৮টি আসনে জিতেছে। গতবারও দলটির আসন সংখ্যা একই ছিল।
এছাড়া এবার এম করুণানিধি মুথুবেলের দল দ্রাবিড় মুন্নেত্রা কাজাগাম ২৩টি, যুবজন শ্রমিক রিথু কংগ্রেস পার্টি ২২টি, জনতা দল (ইউনাইটেড) ১৬টি, বিজু জনতা দল ১২টি, বহুজন সমাজ পার্টি ১০টি, তেলেঙ্গানা রাষ্ট্র সমিতি ৯টি এবং লোক জন শক্তি পার্টি ছয়টি আসনে জয়লাভ করেছে।
অন্য যেসব দল এবার লোকসভায় প্রতিনিধি পাঠাতে যাচ্ছে সেগুলো হল- আম আদমি পার্টি ১টি, এজেএসইউ পার্টি ১টি, অল ইন্ডিয়া আন্না দ্রাবিড় মুন্নেত্রা কাঝাঘাম (এডিএমকে) ১টি, অল ইন্ডিয়া মজলিস ই-ইত্তেহাদুল মুসলিমিন ২টি, অল ইন্ডিয়া ইউনাইটেড ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট ১টি, কমিউনিস্ট পার্টি ইন্ডিয়া (সিপিআই) ২টি, কমিউনিস্ট পার্টি ইন্ডিয়া (সিপিএম) ৩টি, ইন্ডিয়ান ইউনিয়ন মুসলিম লীগ ৩টি, জম্মু ও কাশ্মীর ন্যাশনাল কনফারেন্স ৩টি, জনতা দল (সেকুলার) ১টি, ঝাড়খণ্ড মুক্তি মার্চ ১টি, কেরালা কংগ্রেস (এম) ১টি, মিজো ন্যাশনাল ফ্রন্ট ১টি, নাগা পিপলস পার্টি ১টি, ন্যাশনাল পিপলস পার্টি ১টি, ন্যাশনালিস্ট কংগ্রেস পার্টি ৫টি, ন্যাশনালিস্ট ডেমোক্রেটিক প্রগ্রেসিভ পার্টি ১টি, রেভল্যুশনারি সোস্যালিস্ট পার্টি ১টি, সমাজবাদী পার্টি ৫টি, শিরোমনি আকালি দল ২টি, সিকিম ক্রান্তিকারি মোর্চ ১টি, তেলেগু দেসাম ৩টি এবং অন্যান্য ৮টি।
আদভানির পা ছুঁয়ে আশীর্বাদ : বিজেপির বিশাল জয়ের একদিন পর নরেন্দ্র মোদি শুক্রবার সকালে দলের দুই বর্ষীয়ান নেতা লালকৃষ্ণ আদভানি এবং মুরলি মনোহর যোশির সঙ্গে দেখা করে তাদের আশীর্বাদ নিয়েছেন। আদভানির পা ছুঁয়ে মোদি আশীর্বাদ নেন। এ সময় তার সঙ্গে বিজেপি সভাপতি অমিত শাহ ছিলেন।
আদভানি ও যোশির সঙ্গে সাক্ষাতের ছবি টুইটারে পোস্ট করেন মোদি-শাহ জুটি। টুইটে মোদি বলেছেন, ‘বিজেপির এ সফলতা সম্ভব হয়েছে, এসব নেতার বছরের পর বছর দলের সংগঠনের হয়ে কাজ করার জন্য। তারা মানুষের কাছে পৌঁছে দিয়েছেন দলের সঠিক আদর্শ।’
যোশিকে জড়িয়ে ধরেন অমিত শাহ। টুইটে যোশির প্রশংসাও করেছেন তিনি। আদভানিকে প্রণাম করে মোদির আশীর্বাদ নেয়ার ছবি সোশ্যাল মিডিয়ায় ভাইরাল হয়েছে।
এদিকে এক বিবৃতিতে আদভানি বলেছেন, হৃদয়গ্রাহী অভিনন্দন নরেন্দ্র মোদিকে। পাশাপাশি বিজেপি সভাপতি অমিত শাহ এবং কর্মীদের প্রচেষ্টার ফলেই বিজেপি এ সাফল্য পেয়েছে বলে জানিয়েছিলেন আদভানি। ২০১৪ সালে শেষবার গান্ধীনগর থেকে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছিলেন আদভানি।
এবার তার আসন থেকে অমিত শাহকে প্রার্থী করা হয়। প্রায় ৮ লাখের বেশি ভোটে জয়লাভ করেন তিনি। আদভানিকে প্রার্থী না করায় মোদি ও শাহের ওপর তিনি ক্ষুব্ধ ছিলেন বলেও জানা গিয়েছিল। নিজস্ব ব্লগে বিজেপির বর্তমান নীতির ওপরও প্রশ্ন তুলেছিলেন আদভানি।
দলীয় সিদ্ধান্তে এবারের নির্বাচনে দুই বর্ষীয়ান নেতা আদভানি ও যোশিকে টিকিট দেয়া হয়নি। এ ঘটনার জেরে তাদের মনে আঘাত লেগেছিল। জ্যেষ্ঠ দুই নেতার বাড়ি যাওয়ার পর তাদের প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শন করে সেই ক্ষত পূরণের চেষ্টা করলেন দুই গেরুয়া কাণ্ডারি।
লোকসভা ভোটের পরদিনই দলের প্রবীণ নেতাদের সঙ্গে সাক্ষাতের চিত্রটা নিতান্তই সহজাত নয়। সম্প্রতি বিজেপির বর্তমান নীতি ও আদর্শগত কার্যপ্রক্রিয়ার সমালোচনার একটি ব্লগ পোস্ট করেছিলেন আদভানি । দু’জনের মধ্যেই মতান্তর হলেই তাকে ‘দেশদ্রোহী’ তকমা দেয়ার প্রবণতা বর্তমানে দেখা যায় তা বিজেপির মধ্যে কখনই ছিল না’- ব্লগে লিখেছিলেন বিজেপির অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা সদস্য আদভানি।
দেশের রাজনৈতিক যেভাবে মোদি-শাহ জুটির বিজয়ধ্বজা উড়ছে সেই পরিপ্রেক্ষিতে আদভানির এই লেখনী স্বাভাবিকভাবেই বিতর্কের সূত্রপাত করে। মোদির বিজেপি ও আদভানির বিজেপি তাহলে অনেকটাই পরিবর্তিত? বিশেষ করে গান্ধীনগর থেকে আদভানির পরিবর্তে অমিত শাহকে প্রার্থী করায় আদভানির ক্ষোভের বিষয়টিও প্রকাশ্যে আসে।