ভেনেজুয়েলা নিয়ে কেন এতো আগ্রহ যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়ার?

397

আর্ন্তজাতিক ডেস্ক: যুক্তরাষ্ট্র আর রাশিয়ার মধ্যে দ্বন্দ্বের নতুন কেন্দ্র হয়ে উঠেছে ভেনেজুয়েলা। গত কয়েক সপ্তাহ ধরে দক্ষিণ আমেরিকার এই দেশটিকে ঘিরে দুই পরাশক্তির নানা পদক্ষেপে সেখানকার সংকট আরো ঘনীভূত হয়ে উঠেছে।

বিরোধী নেতা হুয়ান গুয়াইদোর ব্যর্থ অভ্যুত্থান চেষ্টার পর দুই দেশই পরস্পরের বিরুদ্ধে অভিযোগ করছে যে, তারা ভেনেজুয়েলার অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে নাক গলাচ্ছে।আমেরিকান থিংক ট্যাংক র‍্যান্ড কর্পোরেশনের বিশ্লেষক জেমস ডোবিন্স বলেছেন, একটা সময়ে মনে করা হতো যে, ভেনেজুয়েলার সংকট আসলে দুই নেতা মাদুরো আর গুয়াইদোর মধ্যকার একটি বিরোধ। কিন্তু এখন সেটা বরং রাশিয়া আর যুক্তরাষ্ট্রের বিরোধ বলেই মনে হচ্ছে। বহু বছর ধরে ভেনেজুয়েলার তেলের প্রধান ক্রেতা ছিল যুক্তরাষ্ট্র এবং অনেক তেল পরিশোধনাগার শুধু আমেরিকায় তেল পাঠানোর জন্যই কাজ করতো।

রাজনৈতিক আর অর্থনৈতিক স্বার্থের ব্যাপারটি এখানে মিলেমিশে ভেনেজুয়েলায় বর্তমান সংকট তৈরি করেছে। হুগো শ্যাভেজের শাসনামলে (১৯৯৯-২০১৩) ওয়াশিংটন এবং কারাকাসের মধ্যে মাঝেমাঝে উত্তেজনা হয়েছে, কিন্তু দুই দেশের মধ্যে বাণিজ্য অব্যাহত ছিল। ২০১৩ সালে মাদুরো ক্ষমতায় আসার পর দুই দেশের সম্পর্ক নষ্ট হতে থাকে। দেশটির অনেক ব্যক্তি এবং কোম্পানির বিরুদ্ধে অবরোধ আরোপ করা হলে সংকট আরও ঘনীভূত হয়। যখন ভেনেজুয়েলা থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র, তখন রাশিয়া আরো ঘনিষ্ঠ হতে শুরু করে। রাশিয়ার অনেক আন্তর্জাতিক নীতিতে সমর্থন দিতে শুরু করে ভেনেজুয়েলা।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ২০১৪ সালে ক্রিমিয়াকে সংযুক্ত করার পর রাশিয়া যে কোণঠাসা অবস্থায় পড়েছিল, সেটি কাটাতে মস্কো অন্যত্র বন্ধু খোঁজার চেষ্টা শুরু করে।

ইউক্রেনে সাবেক মার্কিন রাষ্ট্রদূত স্টিভ পিফ বলেন, মস্কো এখন এমন দেশ খুঁজছে, যারা আগ্রহের সাথে তাদের সঙ্গে সম্পর্ক করবে, আর এরকম একটি দেশ হলো ভেনেজুয়েলা।

যুক্তরাষ্ট্র যত সরে যেতে শুরু করেছে, রাশিয়া ততই ভেনেজুয়েলার সঙ্গে জড়িত হতে শুরু করে। গত এক দশক ধরে রাশিয়ার তেল কোম্পানি রোসনেফ্ট দেশটির তেল খাতে তাদের বিনিয়োগ বাড়িয়েই চলেছে। অনেক বিশেষজ্ঞ ধারণা করেন, ২০০৬ সাল থেকে প্রায় দুই হাজার কোটি ডলার ঋণের বদলে তেল নিয়েছে রোসনেফ্ট ও রাশিয়ার সরকার।

ডোবিন্স বলছেন, রাশিয়ার ঋণ পুরোপুরি পরিশোধের ক্ষমতা নেই ভেনেজুয়েলার সরকারের। আর দেশটিতে ক্ষমতার পরিবর্তন মানে হলো তাদের অর্থকড়ি ফেরতের সম্ভাবনা আটকে যাওয়া। সন্দেহ নেই যে, যুক্তরাষ্ট্রের জন্য ভেনেজুয়েলা বরাবরই গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্যিক অংশীদার এবং সেই সম্পর্ক পুনরায় স্থাপন করতে চাইবে। কিন্তু আমি এই অভিযোগ মানতে রাজি নই যে, যুক্তরাষ্ট্র তাদের তেল সম্পদের নিয়ন্ত্রণ নিতে চায়।

কলম্বিয়ার রাজনীতি ও আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিষয়ক গবেষক ভ্লাদিমির রোভিন্সিকি বলছেন, রাশিয়ার কাছে আসলে তেল নয়, ভেনেজুয়েলায় অন্য স্বার্থ রয়েছে। ২০১৪ সাল থেকে ব্যবসার দিক থেকে রাশিয়া অনেক বিনিয়োগ ঝুঁকিতে পড়েছে। ভেনেজুয়েলার তেলের খনি থেকে লাভ করতে হলে সেখানে বিপুল পরিমাণ বিনিয়োগ করতে হবে। ‘রাশিয়ানরা আসলে মাদুরো সরকারকে সহায়তা করার জন্য এই আবরণ দিয়েছে। কারণ রোসনেফ্টের যেখানে নিজস্ব তেল খনি রয়েছে, সেখানে ভেনেজুয়েলার তেলের পেছনে এতো বেশি অর্থ বিনিয়োগ করার কোন মানে নেই।

ডোবিন্সও বলছেন, আমেরিকান তেল আর গ্যাস শিল্প আমদানির ওপর কমই নির্ভরশীল। একটা মূল বিষয় হলো যে, পুতিন রাশিয়ার জনগণকে একটি বার্তা দিতে চান। রাশিয়ার জনগণকে এটা দেখানো জরুরি যে, অবরোধ সত্ত্বেও রাশিয়া একটি পরাশক্তি হিসাবে ভূমিকা রাখছে এবং তার বন্ধু দেশ রয়েছে।

তবে ভেনেজুয়েলার ব্যাপারটি ওয়াশিংটনের অভ্যন্তরীণ রাজনীতির জন্য গুরুত্বপূর্ণ। ভ্লাদিমির রোভিন্সিকি বিশ্বাস করেন, মস্কো তাদের নিজস্ব খেলায় ওয়াশিংটনকে ব্যস্ত রাখতে চাইছে। রাশিয়ানদের মতে, ইউক্রেন, জর্জিয়া এবং অন্য সাবেক সোভিয়েত দেশগুলোর মতো প্রতিবেশী দেশের সঙ্গে মস্কোর যে সমস্যা রয়েছে, তা আমেরিকান মদদে হয়েছে।

সুতরাং, রোভিন্সিকি বলছেন, রাশিয়াও চাইছে ল্যাটিন আমেরিকা ও ক্যারিবিয়ান দেশগুলোয় নিজেদের প্রভাব বিস্তার করতে, যা হতে পারে আমেরিকার পেছন দরজায় কড়া নাড়ার মতো। রাশিয়ার সরকার ভাবতে পারে, তারা যদি ভেনেজুয়েলা এবং কিউবার মতো দেশের ওপর প্রভাব বিস্তার করতে পারে, তাহলে রাশিয়ার প্রতিবেশী দেশগুলোকে ঘিরে যুক্তরাষ্ট্রের নীতি বদলাতে চাপ তৈরি করতে পারে।

ডোবিন্স বলছেন, এই অঞ্চলে রাশিয়ার ভূমিকাকে সবসময়েই হুমকি হিসাবে দেখে আসছে ওয়াশিংটন। ফলে যেসব দেশ রাশিয়াকে সমর্থন করে, তাদের যুক্তরাষ্ট্র বিশ্বাস করতে পারে না। মাদুরো যদি ক্ষমতায় টিকে থাকতে পারে, তাহলে রাশিয়া এটা প্রমাণ করে দেবে যে, তারা একটি সরকারকে টিকিয়ে রাখতে পারে, যেমনটা করেছে সিরিয়ায়। আর মাদুরোকে যদি বিদায় নিতে হয়, তাহলে যুক্তরাষ্ট্র এটা প্রমাণ করতে পারবে যে, তারা অপছন্দের কোন সরকারকে হটিয়ে দিতে পারে, যা রাশিয়ার জন্য একটি বড় ঝুঁকি হিসাবে দেখা হবে।

সূত্র: বিবিসি বাংলা

Leave A Reply

Your email address will not be published.