নিউইয়র্কে ‘কাওরান বাজার’ এবং একজন ইলিয়াস খান

380

নিউইয়র্ক থেকে : সততা এবং নিষ্ঠার সাথে দায়িত্ব পালনের পুরস্কার পেলেন মোহাম্মদ ইলিয়াস খান। স্টুডেন্ট ভিসায় যুক্তরাষ্ট্রে আসার ২২ বছরের মাথায় বিপুল অর্থবিত্তের ব্যবসার মালিক হয়েছেন ময়মনসিংহের হালুয়াঘাট উপজেলার চাঁদশ্রী গ্রামের ইলিয়াস খান (৪০)। বাংলাদেশের রাজধানী কাওরান বাজারের আদলে সাজিয়েছেন ৪/৫টি সুপার মার্কেট/রেস্টুরেন্ট/পার্টি হল।

মৃদুভাষী ইলিয়াস খান আমেরিকান স্বপ্ন পূরণের অভিযাত্রায় ফেলে আসা পাড়া-প্রতিবেশীকেও সম্পৃক্ত করতে ভুলেননি।

বাংলাদেশের কৃষিমন্ত্রী বেগম মতিয়া চৌধুরীর ছাগল বিতরণ কর্মসূচি তারই শুরু করা দারিদ্র বিমোচনের সম্প্রসারণ বলেও দাবি করেন ইলিয়াস খান। শুধু ছাগল নয়, গরিব কৃষক পরিবারকে গাভী প্রদানও করেছেন। রিকশা এবং সেলাই মেশিন প্রদানের পাশাপাশি হালুয়াঘাটের গরিব অথচ মেধাবি ছাত্র-ছাত্রীদের মধ্যে বৃত্তি প্রদানের প্রকল্পও রয়েছে ইলিয়াস খানের।

নিউইয়র্ক সিটির জ্যামাইকায় হিলসাইড, শাটফিন বুলেভার্ড এলাকায় ইলিয়াস খানের ব্যবসা-সাম্রাজ্যের ঘোষণা দেয় কাওরান বাজার সুপার মার্কেট, স্টার কাবাব রেস্টুরেন্ট ও পার্টি হল এবং জ্যাকসন হাইটস সংলগ্ন উডসাইডে এসোসিয়েট সুপার মার্কেট। বাংলাদেশি তথা দক্ষিণ এশিয়ান ছাড়াও আমেরিকান-চায়নিজ-স্প্যানিশদের প্রিয় প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে কাওরান বাজার সুপার মার্কেট।

ইলিয়াস খান বললেন, বাংলাদেশ থেকেও প্রতি মাসে ১৫/২০টি কন্টেইনারে ফ্রোজেন ফিশসহ বহু রকমের শুকনা খাদ্য আমদানি করে ‘সাভার সী ফুড’র ব্যানারে সারা আমেরিকায় বাজারজাত করছি। নিজস্ব ব্র্যান্ডের অন্যতম হচ্ছে কালিজিরা, ক্যাটারিভোগ, মিনিক্যাট। এভাবেই কাওরান বাজারের আদলে গোটা বাংলাদেশটিই এখন বহুজাতিক এ দেশে পরিচিতি পাচ্ছে।

কুইন্সের জ্যামাইকার হিলসাইড এভিনিউতে আজকের দৃশ্য অভিভূত করার মত হলেও এক সময় হাতে গোনা কিছু লোকের আনাগোনা ছিল। তেমন সময়ে অর্থাৎ ২০০৪ সালে ১৬৮ প্লেসের ওপর কাওরান বাজার সুপার মার্কেটের যাত্রা শুরু। সেটি ছিল পূর্ণাঙ্গ একটি সুপার মার্কেট। ক্রমে তা জনপ্রিয়তা পাওয়ায় আশপাশে বিস্তৃত হতে থাকে গ্রোসারী তথা সুপারমার্কেটের। প্রবাসীদেরও বসতি সন্তোষজনকভাবে বেড়েছে। সবকিছু মিলিয়ে নিউইয়র্ক সিটিতে বাংলাদেশি অধ্যুষিত এলাকার মধ্যে হিলসাইড শীর্ষে উঠেছে। চাহিদার সাথে সঙ্গতি রেখে কাওরান বাজারকেও হিলসাইডের অংশে সম্প্রসারণ ঘটানো হয়। পাইকারি-খুচরা সবকিছুতেই এগিয়ে এই সুপার মার্কেট।

ময়মনসিংহ জেলা সদরের আনন্দমোহন কলেজের মেধাবি ছাত্র থাকাবস্থায় ১৯৯৪ সালের শেষার্ধে নিউইয়র্কে এসেছেন ইলিয়াস খান। লাগোয়ার্ডিয়া কম্যুনিটি কলেজে ভর্তি হয়েছিলেন। লেখাপড়ার খরচ জোগাতে বার্গার কিং-এ পার্টটাইম কাজ করেছেন। এক পর্যায়ে ম্যানহাটানে জুইশ মালিকানাধীন একবারে কাজ করতে হয়। সেখানেই ভাগ্যদেবতা হাতছানী দেয় বলে মনে করছেন ইলিয়াস খান। ‘জুইশ মালিক স্টিভ ক্যাপলান আমার কাজে খুবই সন্তুষ্ট হন। কারণ, সততা ও নিষ্ঠার সাথে আমি শুরু থেকে শেষ অবধি কাজ করেছি। ফাঁকি-ঝুঁকি নেই। স্টিভ এসব জেনেছেন তার নিয়মিত কাস্টমারের কাছে থেকে। এর পুরস্কার পেলাম সুপারমার্কেট চালুর সময়ে। স্টিভ আমাকে নানাভাবে সহায়তা করেছেন। জুইশ হয়েও তিনি একজন মুসলমানকে প্রতিষ্ঠিত হবার জন্যে যে সহযোগিতা দিয়েছেন তা আমি স্মরণ করছি গভীর কৃতজ্ঞতার সাথে’-বলেন ইলিয়াস খান। তিনি এখনও আমাকে সাহস দেন আরো সম্মুখে যেতে। স্টিভের মানবিকতায় আমি চিরকৃতজ্ঞ-যা ধর্মীয় বা জাতিগত বিদ্বেষ দূরে সরিয়েছে।

সবকটি ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে দেড় শতাধিক কর্মচারির অধিকাংশই বাংলাদেশি। তারাও নিজ নিজ দায়িত্বে সচেষ্ট রয়েছেন বলে উল্লেখ করলেন ইলিয়াস। সুপার মার্কেটের যাত্রা শুরুর বছরেই বিয়ে করেছেন রংপুরের মেয়ে। তার বড় ছেলে থার্ড গ্রেডে যাচ্ছে এবং ছোটটির বয়স মাত্র এক বছর। ছোট্ট পরিবার নিয়ে ইলিয়াস খানের সংসার। মা-বাবা আসেন মাঝেমধ্যেই। স্বল্প বয়সেই ব্যবসা-বাণিজ্যের এই বিস্তৃতির মধ্যেই ঘনঘন জন্মভূমিতে যান। হালুয়াঘাটের পথ-প্রান্তরের ঘ্রাণ নেন এবং হারিয়ে যান শৈশবের দুর্দান্ত স্মৃতির সাগরে। সে কারণেই জড়িয়ে রয়েছেন ‘হালুয়াঘাট অনার্স স্টুডেন্ট ফোরাম’র সাথে। নিজেও প্রতিষ্ঠা করেছেন ‘বন্ধন সমাজকল্যাণ সংস্থা’ নামক একটি স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন।

এর প্রধান উপদেষ্টা ইলিয়াস খান বললেন, প্রত্যন্ত অঞ্চলের মানুষেরা বিশুদ্ধ পানির সমস্যায় ছিলেন। আমি বেশ কিছু টিউবওয়েল স্থাপন করে দিয়েছি। আগে শুরু করা গরিবদের মধ্যে ছাগল, গাভী, হাঁস-মুরগী, রিকশা, সেলাই মেশিন বিতরণের প্রকল্পও অব্যাহত রেখেছি। সামান্য অর্থে একটি পরিবার ঘুরে দাঁড়াতে পারে সে দৃষ্টান্ত রয়েছে অসংখ্য। এসব দেখে আমি তৃপ্ত হই। নিউইয়র্কে যে শ্রম দিচ্ছি-তা ভুলে যাই। এভাবেই বাংলার মাটি আর মানুষের মধ্যে বেঁচে থাকতে চাই।

প্রচারবিমূখ ইলিয়াস খান কমিউনিটির আত্ম-মানবতার পাশেও দাঁড়ান মাঝেমধ্যেই। সামাজিক-সাংস্কৃতিক-পেশাজীবী সংগঠনেও তার ছোঁয়া থাকে। অর্থাৎ সুপার মার্কেটের মধ্য দিয়ে বাঙালিদের ভোজন-বিলাস জিইয়ে রাখার পাশাপাশি বাঙালিত্ব জাগ্রত রাখতেও বদ্ধপরিকর ব্যবসায়ী ইলিয়াস খান।

এক বস্তা চিনি আর শাক-সব্জি, মাছের পসরা সাজিয়ে শুরু করা কাওরান বাজার সুপারমার্কেটে এখন ট্রাক ভরে চিনি, চাল,ডাল, মাছ-শাক সবজি আসছে। ২০০৪ সালের সে সময়ের ওপর ভর করেই আমি এগুচ্ছি। ২০০৮ সালে এর প্রসার ঘটে শাটফিন বুলেভার্ডে। ২০১১ সালে হিলসাইডে স্টার কাবাব রেস্টুরেন্ট চালু হয়। রেস্টুরেন্টের ব্যপ্তি হিসেবে ২০১৫ সালে হিলসাইডেই স্টার পার্টি হলের যাত্রা শুরু। সাথে রয়েছে সুপরিসর কাওরান বাজার সুপার মার্কেটও। এর দু’বছর আগে জ্যাকসন হাইটসে সন্নিকটে উডসাইডে রুজভেল্ট এভিনিউর ওপর ‘এসোসিয়েট সুপার মার্কেট’ চালু করেছেন।

ইলিয়াসের স্বপ্ন বড় কিছু নয়। পাটেল ব্রাদার্সের চেয়েও বড় চেইন স্টোরের পরিচালক-অধিকর্তা হতে চান ‘কাওরান বাজার’ ব্র্যান্ডে। এর মধ্য দিয়েই গোটা আমেরিকাকে কাওরান বাজারে পরিণত করার অভিপ্রায় তার।

Leave A Reply

Your email address will not be published.