তাকওয়ার উৎসব কোরবানি ও ঈদ
ঈদ অর্থ আনন্দ, কোরবানি অর্থ নৈকট্য, আত্মত্যাগ। কোরবানি ঈদ অর্থ হলো ত্যাগের উৎসব। পরিভাষায় কোরবানি ঈদ হলো আল্লাহর নৈকট্য লাভের উদ্দেশ্যে জিলহজ মাসের ১০, ১১ ও ১২ তারিখে ভেড়া, ছাগল, দুম্বা, গরু, মহিষ ও উট জবেহ করে আনন্দ উদ্যাপন করা। আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘সকল সম্প্রদায়ের জন্য আমি কোরবানির বিধান দিয়েছি, তিনি তাদেরকে জীবনোপকরণস্বরূপ যে সকল চতুষ্পদ জন্তু দিয়েছেন, সেগুলোর ওপর যেন তারা আল্লাহর নাম উচ্চারণ করে।’ (সুরা-হজ, আয়াত: ৩৪)। মুসলমানদের বড় দুটি উৎসবের মধ্যে একটি হলো ঈদুল আজহা বা কোরবানির ঈদ। আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘আল্লাহর নিকট ওদের গোশত রক্ত পৌঁছায় না; বরং পৌঁছায় তাঁর কাছে তোমাদের তাকওয়া।’ (সুরা-২২ হজ, আয়াত: ৩৭)।
ইতিহাস ও ঐতিহ্যে কোরবানি
পৃথিবীর ইতিহাসে সর্বপ্রথম কোরবানি করেছেন আদমপুত্র হাবিল ও কাবিল। হাবিল ছিলেন মেষপালক, তিনি তাঁর মেষের পাল হতে সবচেয়ে উত্তম মেষটি আল্লাহর রাহে কোরবানি করলেন। কাবিল ছিলেন কৃষিজীবী, তিনি কিছু শস্যদানা কোরবানির জন্য উৎসর্গ করলেন। হাবিলের কোরবানি কবুল হলো, প্রমাণস্বরূপ আকাশ হতে অগ্নি এসে তার কোরবানিকে ভস্মীভূত করল। কাবিলের কোরবানি কবুল হলো না, আর তা অমনি পড়ে থাকল। ইব্রাহিম (আ.) ও ইসমাইল (আ.)-এর সময় থেকে প্রচলন হলো বর্তমান কোরবানি। রহিত হলো কোরবানি কবুল হওয়া না-হওয়ার চাক্ষুষ রীতি। কোরবানি কবুল হওয়া না হওয়া গোপন রাখা হলো। আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘আদম (আ.)–এর পুত্রদ্বয়ের বৃত্তান্ত আপনি তাদেরকে শোনান। যখন তারা উভয়ে কোরবানি করেছিল তখন একজনের কোরবানি কবুল হলো আর অন্যজনেরটা কবুল হলো না। অবশ্যই আল্লাহ মুত্তাকিনদের কোরবানি কবুল করেন।’ (সুরা-৫ মায়িদা, আয়াত: ২৭)।
ইমাম মুহাম্মাদ ইবনে জারির তাবারী (র.) বর্ণনা করেন, রাসুলুল্লাহ (সা.) দ্বিতীয় হিজরিতে প্রথম ঈদ পালন করেন। সাহাবায়ে কেরাম বললেন, হে আল্লাহর রাসুল! কোরবানি কী? নবীজি (সা.) বললেন, এ হলো তোমাদের পিতা ইব্রাহিম (আ.)-এর সুন্নত। সাহাবায়ে কেরাম (রা.) বললেন, এতে আমাদের জন্য কী রয়েছে? মহানবী (সা.) বললেন, কোরবানি জন্তুর প্রতিটি পশমে একটি করে নেকি। সাহাবায়ে কেরাম সবিস্ময়ে বললেন, ইয়া রাসুলুল্লাহ! আমরা যদি ভেড়া কোরবানি করি (ভেড়ার তো অনেক বেশি পশম)? রাসুল (সা.) বললেন, তাতেও প্রতি পশমে নেকি পাবে। (আল বিদায়া ওয়ান নিহায়া, মুহাম্মাদ ইবনে কাছীর)।
হজরত ইব্রাহিম (আ.)-এর কোরবানির ইতিহাসও কোরআনে এসেছে, (তিনি বললেন) ‘হে আমার প্রতিপালক! আমাকে নেক সন্তান দান করুন। অতঃপর আমি তাকে এক সহিষ্ণু পুত্রের সুসংবাদ দিলাম’, অতঃপর সে যখন তার পিতার সঙ্গে কাজ করার বয়সে উপনীত হলো তখন ইব্রাহিম (আ.) বললেন, ‘হে বত্স! আমি স্বপ্নে দেখেছি যে তোমাকে আমি জবাই করছি, তোমার অভিমত কী?’ সে বলল, ‘হে আমার পিতা! আপনি যা আদিষ্ট হয়েছেন তা–ই করুন। আল্লাহর ইচ্ছায় আপনি আমাকে ধৈর্যশীলদের অন্তর্ভুক্ত পাবেন।’ যখন তারা উভয়ে আনুগত্য প্রকাশ করল এবং ইব্রাহিম (আ.) তার পুত্রকে কাত করে শোয়াল, তখন আমি তাকে ডাক দিয়ে বললাম, ‘হে ইব্রাহিম! আপনি তো স্বপ্নাদেশ সত্যই পালন করলেন! এভাবেই আমি সত্কর্মশীলদের পুরস্কৃত করে থাকি। নিশ্চয় এটা ছিল এক সুস্পষ্ট পরীক্ষা। আমি তাকে মুক্ত করলাম এক মহান কোরবানির বিনিময়ে। আমি এটা পরবর্তীদের স্মরণে রেখে দিলাম। ইব্রাহিম (আ.)-এর জন্য অভিবাদন! আল্লাহর পক্ষ থেকে শান্তি ও শুভেচ্ছা।’ (সুরা সাফফাত, আয়াত: ১০০-১১০)।
যাঁদের কোরবানি ওয়াজিব
১০ জিলহজ সকাল থেকে ১২ জিলহজ সূর্যাস্তের পূর্ব পর্যন্ত যেকোনো সময় যাঁরা নিসাব পরিমাণ সম্পদ (সাড়ে সাত ভরি স্বর্ণ বা সাড়ে বায়ান্ন ভরি রুপা অথবা এ উভয়ের যেকোনো একটির মূল্য সমপরিমাণ) ব্যবসাপণ্য বা নগদ অর্থের মালিক থাকবেন বা হবেন, তাঁদের কোরবানি করা ওয়াজিব। হাদিসে রয়েছে, কোরবানি হজরত ইব্রাহিম (আ.)-এর সুন্নত। এখানে সুন্নত অর্থ তরিকা, পদ্ধতি, আদর্শ, অনুসৃত বিষয়। আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘ফা ছল্লি লিরব্বিকা ওয়ানহার’ অর্থাৎ হে নবী (সা.)! আপনি আপনার রবের উদ্দেশ্যে নামাজ পড়ুন এবং কোরবানি করুন। (সুরা কাওসার, আয়াত: ২)। রাসুলুল্লাহ (সা.) এরশাদ করেন, ‘যে ব্যক্তি সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও কোরবানি করে না, সে যেন আমাদের ঈদগাহের ধারেকাছেও না আসে।’ (ইবনে মাজা)। হাদিসে আছে, কোরবানির দিনগুলোতে পশু কোরবানির চেয়ে শ্রেষ্ঠ আমল আর নেই।
কোরবানির কিছু নিয়মকানুন
ভেড়া, ছাগল, দুম্বা একটি একজনের পক্ষ থেকে কোরবানি করা যাবে। গরু, মহিষ, উট একটি সাতজনের পক্ষ থেকে কোরবানি করা যাবে। শরিকে কারও অংশ এক-সপ্তমাংশ হিসেবে বেশি বা কম হতে পারে। জীবিত-মৃত যে কারও নামে কোরবানি দেওয়া যায়। ওয়াজিব কোরবানি ও নফল কোরবানি একসঙ্গে দেওয়া যায়। কোরবানির সঙ্গে আকিকাও দেওয়া যায়। ছাগল, ভেড়া, দুম্বা কমপক্ষে এক বছরের হতে হবে। গরু, মহিষ অন্ততপক্ষে দুই বছরের হতে হবে; উট তিন বছরের হতে হবে। কোরবানির গোশত তিন ভাগে ভাগ করে এক ভাগ গরিব-মিসকিনদের দেওয়া, এক ভাগ আত্মীয়স্বজনকে দেওয়া এবং এক ভাগ নিজেদের পরিবারের জন্য রাখা মোস্তাহাব।
কোরবানি ও আকিকার গোশত ধনী-গরিব, আত্মীয়-অনাত্মীয় সবাই খেতে পারেন। কোরবানির পশুর চামড়া যেকোনো কাউকে হাদিয়া বা দান করা যাবে; এতিমখানায়ও দেওয়া যাবে। কোরবানির পশুর চামড়া, হাড়, শিং, চর্বি যেকোনো অংশ বিক্রয় করলে তা গরিবের হক হয়ে যাবে।
ঈদের নামাজের পর কোরবানির পশু জবাই করতে হয়, আগে নয়। কোরবানিদাতা নিজ হাতে জবাই করাই উত্তম। নারীরাও ইচ্ছা করলে পশু জবাই করতে পারেন। অন্যকে দিয়ে জবাই করালে তার চাহিদামতো সম্মানী দিয়ে তাকে খুশি করতে হবে। কোরবানির মাংস কাটাকুটির লোকদেরও ন্যায্য মজুরি দিতে হবে, মজুরির বাইরে তাদের গোশতও দেওয়া যাবে। তবে পারিশ্রমিকের পরিবর্তে গোশত দেওয়া যাবে না। কোরবানির দিনগুলোতে হাঁস-মুরগি বা কোনো পাখি জবাই করতে বাধা নেই। কোরবানি ছাড়াও পশু জবাই করতে নিষেধ নেই।
মুফতি মাওলানা শাঈখ মুহাম্মাদ উছমান গনী: বাংলাদেশ জাতীয় ইমাম সমিতির যুগ্ম মহাসচিব ও আহ্ছানিয়া ইনস্টিটিউট অব সুফিজমের সহকারী অধ্যাপক
smusmangonee@gmail.com