আরও ৫ হাজার রোহিঙ্গা ভাসানচরে যাচ্ছেন আজ ও আগামীকাল

238

ঢাকা: তৃতীয় দফায় আরো ৫ হাজার রোহিঙ্গা ভাসানচর যাবার প্রস্তুতি নিয়েছেন। দ্বিতীয় দফায় ভাসানচরে যাবার এক মাসের মাথায় বৃহস্পতি ও শুক্রবার (২৮ ও ২৯ জানুয়ারি) চার ভাগে তাদের ক্যাম্প ছাড়ার প্রস্তুতি নিয়েছে সংশ্লিষ্টরা। প্রথম ভাগে বৃহস্পতিবার দুপুরে ক্যাম্প ছেড়েছেন কক্সবাজারের উখিয়া-টেকনাফে মানবিক আশ্রয়ে থাকা রোহিঙ্গাদের একটি দল, এমনটি জানিয়েছে সংশ্লিষ্ট সূত্র। 

বৃহস্পতিবার (২৮ জানুয়ারি) বেলা ১২টার দিকে প্রথম ১৮টি বাস ভর্তি রোহিঙ্গা ট্রানজিট পয়েন্ট অতিক্রম করে বলে জানিয়েছে প্রত্যক্ষদর্শীরা। পরে বিকেলে আরো ডজনাধিক বাস রোহিঙ্গা নিয়ে চট্টগ্রামের পথে বের হওয়ার কথা রয়েছে। তবে সংশ্লিষ্ট কেউ এবার এ বিষয়ে মুখ খুলছেন না। 

আগের মতো উখিয়া ডিগ্রি কলেজ মাঠ এলাকা থেকে দিনে দু’ভাগে ভাগ করে বাসগুলো চট্টগ্রামের উদ্দেশ্যে ছেড়ে যাবার প্রস্তুতি রেখেছেন সংশ্লিষ্টরা। উখিয়ার মূল ক্যাম্প ছাড়াও পুরো ৩৪ ক্যাম্প থেকেই ভাসানচরে যেতে ইচ্ছুক রোহিঙ্গারা ট্রানজিট পয়েন্টে বুধবার বিকেল থেকে আসতে শুরু করে। বাকিরা বৃহস্পতিবার সকাল ও দুুুপুরে এসে পৌঁছায়। শুক্রবার যারা ভাসানচরের পথে বের হবে তারা বৃহস্পতিবার সন্ধ্যা ও শুক্রবার সকাল-দুপুরে ট্রানজিট পয়েন্ট আসবে বলে জানিয়েছেন রোহিঙ্গা নেতারা। দুইদিনের যাত্রায় প্রায় ৮০ টা বাস, একাধিক ট্রাক ও প্রয়োজনীয় অন্য যানবাহন প্রস্তুত রয়েছে। 

বৃহস্পতিবার বেলা ১২টার দিকে উখিয়া ডিগ্রি কলেজ মাঠ থেকে ছেড়ে যাওয়া বাসে ৩০জন করে রোহিঙ্গা রয়েছে বলে সংশ্লিষ্টদের অভিমত। এসব গাড়ি বহরের আগে ও পেছনে পুলিশের গাড়ি এবং একটি এ্যাম্বুলেন্স রয়েছে।

সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, এবারেও স্বেচ্ছায় যেতে রাজি হওয়া কমপক্ষে ৫ হাজার রোহিঙ্গাকে ভাসানচরে পৌঁছে দেয়া হবে। বুধবার বিকেল থেকে উখিয়া-টেকনাফের ৩৪টি ক্যাম্প থেকে রোহিঙ্গাদের ভাসানচরে নিয়ে যেতে উখিয়া কলেজ মাঠে অস্থায়ী ট্রানজিট পয়েন্টে রাখা হয়।

নিবন্ধিত ও অনিবন্ধিত ক্যাম্পের মাঝিরা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, “দু’দফায় ভাসানচরে যাওয়াদের জীবনচিত্র সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে দেখে এখন অনেকে আগ্রহী হয়ে অপেক্ষা করছে। কিন্তু প্রথম যাত্রার আগে অনেক বুঝিয়েও জড়ো করা কষ্টকর ছিল। এখন চিত্র পাল্টেছে। এখন রোহিঙ্গারা ভাসানচরে যেতে নিজেরাই তালিকায় নাম লিখিয়েছে। ভাসানচরে ৪ ও ২৮ ডিসেম্বর যাদের আত্মীয়স্বজন গেছে, তাদের কাছে সুযোগ-সুবিধার খবর শুনেই অনেকেই সেখানে যেতে অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছে”।

তারা আরো জানায়, প্রথমবার জোর করে গোপনে বিভিন্ন অপপ্রচার থেকে লুকিয়ে তাদের ট্রানজিট ক্যাম্পে আনা হয়েছিল, এখন সেরকম নয়। বিকেলে অনেকেই প্রথম ট্রিপের যাত্রী হতে ক্যাম্পে এসে পড়েছে।

জানা গেছে, উখিয়া ও টেকনাফের তালিকাভুক্ত (রেজিস্ট্রার) ক্যাম্প ছাড়া বাকি সব ক্যাম্প থেকেই যাচ্ছে রোহিঙ্গারা। 

উখিয়ার তাজনিমারখোলা রোহিঙ্গা ক্যাম্পের মাঝি মো. ইব্রাহিম বলেন, “আমার ব্লক থেকে বেশ কয়েকটি পরিবার ভাসানচরে যাচ্ছে। তাদের কাউকে জোর করা হয়নি”।

কুতুপালং মধুরছরা ক্যাম্পের সাবেক মাঝি মোহাম্মদ নুর বলেন, “এ ক্যাম্প থেকেও ১২টি পরিবার নোয়াখালীর ভাসানচরে যাচ্ছে। প্রথম দফায় যারা গেছে, তাদের কাছ থেকে সুযোগ-সুবিধার খবর জেনেই নতুন করে অনেকেই যেতে আগ্রহী হয়েছে”।ভাসানচরে রোহিঙ্গাদের জন্য তৈরি করা স্থাপনা। ছবি: শামসুদ্দিন ইলিয়াস

তিনি বলেন, ” যারা যাচ্ছে তারা বলছেন- মিয়ানমার যে টালবাহানা শুরু করেছে তাতে স্বল্প সময়ে নিজ দেশে ফেরার কোন সম্ভাবনা নেই। সুতরাং আশ্রিত জীবনে বাংলাদেশ সরকার যেখানেই রাখে তাতো একই রকম। সেখানে পাহাড়ি ঝুপড়ির চেয়ে দ্বীপের সুন্দর দালান অনেক উত্তম। ক্যাম্পে একটু জোরে বাতাস হলে চালা উড়ে যাবার ভয়টা অন্তত থাকবে না”।  

সূত্র মতে, নোয়াখালীর হাতিয়ায় সাগরের মাঝে ভেসে থাকা ভাসানচরে রোহিঙ্গাদের জন্য সব ধরনের সুবিধা সংবলিত ঘর নির্মাণ করা হয়েছে। ঝড় জলোচ্ছ্বাস থেকে সুরক্ষায় রয়েছে বিশেষ ব্যবস্থাও। বসবাসের যে ব্যবস্থা করা হয়েছে তা দেখতে গত সেপ্টেম্বরে দুই নারীসহ ৪০ রোহিঙ্গা নেতাকে সেখানে নিয়ে যায় সরকার। ভাসানচরের আবাসন ব্যবস্থা দেখে মুগ্ধ হয়ে তারা ক্যাম্পে ফিরে অন্যদের ভাসানচরে যেতে উদ্বুদ্ধ করে। দু’বছর আগে সরকার ভাসানচরে এক লাখ রোহিঙ্গাকে স্থানান্তরের সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। কিন্তু তাদের অনিচ্ছার কারণে তা সম্ভব হচ্ছিল না। অবশেষে এর যাত্রা শুরু হওয়ায় উখিয়া-টেকনাফের সাধারণ মানুষ স্বস্তি প্রকাশ করছেন। 

এর আগে গত ৪ ডিসেম্বর প্রথম দফায় এক হাজার ৬৪২ আর দ্বিতীয় দফায় ৪২৮টি পরিবারের এক হাজার ৮০৫ রোহিঙ্গাকে ভাসানচরে স্থানান্তর করা হয়েছে। দুই দফায় স্থানান্তরিত রোহিঙ্গার সংখ্যা এখন ৩ হাজার ৪৪৭। তারও আগে মালয়েশিয়া যেতে গিয়ে সমুদ্র উপকূলে আটক আরও তিন শতাধিক রোহিঙ্গাকে সেখানে নিয়ে রাখা হয়

উল্লেখ করা যেতে পারে, ভাসানচরে রোহিঙ্গাদের জন্য যে আবাসস্থল নির্মাণ করা হয়েছে, তা আধুনিক সুযোগ-সুবিধাসমৃদ্ধ। সব মিলিয়ে কক্সবাজারের চেয়ে ১৮টি উন্নত সুবিধা রয়েছে ভাসানচরে।

ভাসানচরে যেতে আগ্রহী অনেকে জানান, “ভাসানচরে অবস্থান ও রোহিঙ্গাদের মুখে সেখানকার বর্ণনা শুনে এবং প্রথম ধাপে যাওয়া রোহিঙ্গাদের দেয়া অভিজ্ঞতার মাধ্যমে সেখানে যেতে চাই”। তাদের মতে পাহাড়ের ঘিঞ্জি বস্তিতে বসবাসের চেয়ে ভাসানচর অনেক নিরাপদ হবে। এ ছাড়া ভাসানচরে রোহিঙ্গাদের বসবাসের জন্য নির্মিত অবকাঠামো অনেক বেশি আধুনিক সুযোগ সুবিধা রয়েছে বলে মনে করছে রোহিঙ্গারা।

কোনো বলপ্রয়োগ ছাড়াই রোহিঙ্গাদের ভাসানচরে যাওয়ার ইতিবাচক মনোভাব দেখে তাদের সেখানে পাঠানোর বিষয়ে কার্যকর পদক্ষেপ নেয় সরকার। রোহিঙ্গাদের প্রথম ও দ্বিতীয় দলটিকে নিরাপদে ভাসানচরে পাঠাতে পারায় আরও অনেক পরিবার সেখানে যেতে আগ্রহী হচ্ছে বলে মনে করছেন প্রশাসনের এক দায়িত্বশীল সূত্র। 

Leave A Reply

Your email address will not be published.