পবিত্র কুরআন ও হাদীসের আলোকে জুমার নামাজ ঘরে আদায়ের বিধান কী?
ধর্ম ডেস্ক : পবিত্র কুরআনে জুমার নামাজ বিষয়ে একটি সূরা নাজিল করা হয়েছে। সূরা জুমআ। সূরার নাম দোয়া সূরা জুমআ হলেও এ সূরার শেষ দু’তিন আয়াতেই কেবল জুমা বিষয়ক বিধান দেয়া হয়েছে।
আরও নির্দিষ্ট করে বললে কেবল ৯ নং আয়াতে জুমার নামাজ সংক্রান্ত নির্দেশনা এসেছে।
আল্লাহ সুবহানাহু তায়ালা ইরশাদ করেন, হে মুমিনগণ, জুমআর দিনে যখন জুমার নামাজের জন্য আহ্বান করা হয় তখন তোমরা আল্লাহর স্মরণে ধাবিত হও এবং ক্রয়-বিক্রয় ত্যাগ কর, এটাই তোমাদের জন্য শ্রেয় যদি তোমরা উপলব্ধি কর। [সূরা জুমআ, আয়াত: ৯]
কোভিড-১৯ তথা নভেল করোনা ছড়িয়ে পড়ার পর পৃথিবীর প্রায় সব দেশেই জারি করা হয়েছে লকডাউনের আইন। লকডাউনের ভেতর সব ধরনের জনসমাগম নিষিদ্ধ। মসজিদে জুমার নামাজেও সে নিষেধাজ্ঞা থাকছে।
মক্কা-মদীনার মসজিদগুলোও বন্ধ করা হয়েছে লকডাউনের কারণে। বাইতুল্লাহ এখনও উন্মুক্ত করা হয়নি তাওয়াফকারীদের জন্য।
উপমহাদেশে মসজিদ বন্ধ না হলেও সীমিত করার নির্দেশ দেয়া হয়েছে মুসল্লি সংখ্যা। অতি সম্প্রতি আমাদের দেশে ধর্ম মন্ত্রণালয় থেকে জুমায় দশের অধিক মুসল্লি জমায়েত করতে নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়েছে। কাছাকাছি বিধান ভারত ও পাকিস্তানেও আমরা জানতে পারছি।
এ পরিস্থিতিতে সাধারণ ধর্মপ্রাণ মুসল্লিরা জুমার দিন জুমা না পড়ার যন্ত্রণা ভোগ করছেন। এক জীবনে যারা কখনও জুমা ত্যাগ করেননি তাদের জন্য জুমা ত্যাগ করা বড়ই কষ্টের।
এ সময় কথা উঠেছে ঘরে জুমা আদায়ের কোনো সুরত আছে কী না? কোরআন-হাদীস এ বিষয়ে কী বলে? হানাফি মাজহাবের ফিকহের কিতাবাদিতেও কোনো নির্দেশনা আছে কী না? ভারত, বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের মুফতিদের মাঝে এ নিয়ে দেখা দিয়েছে চরম মতানৈক্য।
আলেমদের মতানৈক্যে অধিক মনোযোগ না দিয়ে আমরা সরাসরি কোরআনুল কারীমে প্রবেশ করতে পারি। পাঠক আবারও সূরা জুমআর আয়াতটি মনোযোগ দিয়ে দেখুন। মূলত জুমা সংক্রান্ত সমস্ত হাদীস এ আয়াতেরই ব্যাখ্যা। জুমআর বিষয়ে ফিকহের সব মাসআলাও এ আয়াত থেকেই গবেষণা করে বের করা হয়েছে।
আমরাও হোম কোয়ারেন্টিনের সময়ে কিছু কিছু আয়াত নিয়ে গবেষণা করতে পারি। নিজেদের উপলব্ধিকে আরও সমৃদ্ধ করতে পারি পবিত্র কুরআনের সংস্পর্শে থেকে।
আয়াতের সরল অর্থ আরেকবার বলছি, ‘জুমার দিন যখন তোমাদের জুমার জন্য ডাকা হয় তখন তোমরা সবাই জুমার নামাজের জন্য ধাবিত হও।’
আয়াতের এ অংশ থেকে আমরা বুঝতে পারি জুমার নামাজ গোপনে পড়া চলবে না। জুমার জন্য ডাকার কথা বলা হয়েছে। জুমার জন্য সম্মিলিতভাবে ক্রয়-বিক্রয় পরিত্যাগ করে যেতে বলা হয়েছে।
এখান থেকেই হানাফি ফিকহে সাধারণ অনুমতির শর্ত করা হয়েছে। অর্থাৎ এমন স্থানে জুমা হতে হবে যেখানে সর্বসাধারণের প্রবেশের অনুমতি রয়েছে। হাকডাক করে জুমা পড়তে হবে এভাবেও বলার চেষ্টা করছেন অনেকে।
অন্য ইমামরা বলছেন, কুরআনে যে শর্ত নেই এমন কোনো শর্ত করা ঠিক হবে না। তবু জুমা শব্দের অর্থই হচ্ছে জমায়েত। এ জমায়েতের অর্থ নির্ধারণে ফিকহবিদদের মাঝে মতানৈক্য।
হানাফি ফিকহের কোথাও কোথাও ইজনে সুলতান বা রাষ্ট্রপ্রধানের অনুমতির কথাও রয়েছে। বিশেষত ইমাম মুহাম্মাদের কিতাবুল আসল-এ রয়েছে এ ধরনের বিধান।
পঞ্চম শতকের বিখ্যাত ফকীহ শামসুল আইম্মা হুলওয়ানি রহ. অবশ্য বলছেন, ইমাম মুহাম্মাদের সময়ে জুমার খতীব নিয়োগ দেয়া হতো রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে এ জন্য তখন শাসকের অনুমতির শর্ত করা হয়; তা না হলে জুমার নামাজের জন্য শাসকের অনুমতির কোনো শর্ত হানাফি মাজহাবেও নেই। [মুহিতে বুরহানি ২/১৮৯]
ইমাম মালিক তো স্পষ্টই বলছেন জুমার নামাজ পবিত্র কোরআন নির্দেশিত, কাজেই কোনো শাসক থাক বা না থাক জুমা পড়তে হবে। [আহকামুল কুরআন ইবন আরাবি]
মালেকি মাজহাবে ছাদ বিশিষ্ট মসজিদ হওয়া শর্ত জুমা বৈধ হওয়ার জন্য। ইবন আরাবি ও ইবন রুশদ বলছেন, এ শর্তের স্বপক্ষে কোনোই দলিল প্রমাণ পাওয়া যাবে না।
বিশেষত রাসূল সা. ইরশাদ করেছেন আমার জন্য পুরো পৃথিবীকেই মসজিদ বানিয়ে দেয়া হয়েছে। [বুখারী] কাজেই প্রতিটি ঘর রাসূল সা.এর ভাষ্যানুসারে প্রয়োজনে মসজিদ হতে পারে।
জুমার জামাতে ক’জন অংশগ্রহণ করতে হবে? ইমাম আবু হানীফা রহ. সূরা জুমার এ আয়াত থেকে চারজন হওয়ার শর্ত বের করেছেন। কারণ কোরআনে আল্লাহ সুবহানাহু তায়ালা বহুবচন শব্দ ব্যবহার করেছেন। ফাসআউ। তোমরা ধাবিত হও। আরবি বহু বচনের সর্বনিম্ন সংখ্যা তিন। সে হিসেবে তিনজন হওয়ার কথা।
কিন্তু জুমার আজান দেয়ার কথা রয়েছে। তাহলে বোঝা গেল একজন আজান দিবে আর অন্তত তিনজন আজান শুনে জুমার নামাজ আদায় করতে আসবে। এভাবে চারজন হল। [জাসসাস প্রণীত আহকামুল কুরআন ৩/৩৭০]
একটা প্রশ্ন আমাদের থেকে যায়। রাসূল সা.-এর যুগে মদীনা মুনাওয়ারায় আরও বেশকিছু মসজিদ ছিল কিন্তু মসজিদে নববী ছাড়া আর কোথাও তখন জুমা কেন হতো না? জুমা যদি যে কোনো স্থানেই হতে পারে তাহলে কেবল মসজিদে নববীতেই কেন হতো?
এর উত্তর খুবই সোজা। রাসূল সা.-এর যুগে সবাই চাইতেন নবীজীর সংস্পর্শে এসে ধন্য হতে। জুমার সময় সরাসরি নবীজীর মুখ থেকে খুতবা শুনতে চাইতেন তারা। রাসূল সা.-এর তিরোধানের পর এ জন্যই ধীরে ধীরে মদীনার অন্যান্য মসজিদে জুমা চালু হয়।
অবশ্য জুমার নামাজ ঈদের মতো একটি সাপ্তাহিক উৎসব। এর জন্য অধিক লোক সমাগম হওয়া এতে কাম্য। সে জন্যই ফিকহের কিতাবাদিতে এ মাসআলা লেখা হয়েছে যে, এক এলাকায় বিনা প্রয়োজনে একাধিক জুমা হতে পারবে না। তবে প্রয়োজন হলে একাধিক জুমা অবৈধ থাকে না। এ কথা প্রায় সব ফতোয়ার কিতাবেই রয়েছে।
করোনার দিনগুলোতে মসজিদসহ যে কোনো স্থানে লোক সমাগম নিষিদ্ধ। সে হিসেবে ছোট ছোট জুমার প্রয়োজনীয়তা অনস্বীকার্য। এ প্রয়োজনের ভিত্তিতে মুফতীরা পারেন ঘরে ঘরে জুমার বৈধতার ফতোয়া দিতে। এটি নিঃসন্দেহে বিশেষ অবস্থার ফতোয়া হবে।
সাধারণ অবস্থায় বিনা প্রয়োজনে ছোট ছোট জুমা হওয়া কাম্য নয়। সমাজের সব মানুষ সপ্তাহের একদিন একত্র হবে এবং পারস্পরিক সম্প্রীতির পরিবেশ তৈরিতে সহায়ক হওয়ার পক্ষে জুমার নামাজ বড় ভূমিকা রাখে।
কিন্তু এখন ভাইরাস ছড়িয়ে যাওয়ার শঙ্কায় আমাদের সাবধান থাকতে হচ্ছে বড় জমায়েত থেকে। এ অবস্থায় জুমা কী একেবারে পরিত্যাজ্য থাকবে? অন্য শর্ত পাওয়া গেলে ছোট ছোট জামাতে জুমা আদায়ের মন্দ কোনো দিক নেই।
একটি বিষয় ভেবে দেখুন, ইমাম আবু হানীফা রহ. তিন-চারজনে মিলে জুমার নামাজের মাসআলাটি কেন বললেন? এমন বিশেষ অবস্থার কথা চিন্তা করেই বলেছেন। হানাফি ফিকহের এটি এক সৌন্দর্য। ভবিষ্যতে কী ধরনের পরিস্থিতি আসতে পারে সেটি কল্পনা করে হানাফি ফিকহের ইমামরা কোরআন-হাদীস ঘেঁটে আগে থেকেই বহু মাসআলা আবিষ্কার করে গেছেন।
করোনাভাইরাস ছড়িয়ে পড়ছে সবখানে। সতর্কতার খাতিরে আমরা বাড়িতেই নামাজ পড়ব। মসজিদে যাব না পরবর্তী নির্দেশনা আসার আগ পর্যন্ত। জুমার নামাজেও ঘরেই থাকব। যারা পারি ঘরেই জুমা আদায়ের ব্যবস্থা করব।
জুমার জন্য যে সব শর্ত আছে তা কোনো ভালো আলেমের কাছ থেকে জেনে নিব। আর যারা জুমা পড়বেন না তাদের অবশ্যই চার রাকাত জোহর আদায় করতে হবে। তবে জুমা শেষ হওয়ার পর তারা যোহর আদায় করবেন। এলাকার মসজিদে জুমা শেষ হওয়ার পর ঘরে জোহর আদায়ের নিয়ম।
আরেকটি বিষয় হচ্ছে, ঘরের জোহর অবশ্যই একাকী পড়তে হবে। এ বিষয়ে হজরত আলি রা. থেকে স্পষ্ট নির্দেশনা বর্ণিত হয়েছে। [যাইলাই, তাবইনুল হাকাইক] জুমার দিন ঘরে যারা জোহর পড়বেন তারা জামাত ছাড়া একাকী জোহর আদায় করা-ই উত্তম। [ খোলাসাতুল ফতোয়া ১/২১১]
আল্লাহ সুবহানাহু তায়ালা আমাদের সবাইকে করোনার দিনগুলোয় বেশি বেশি ইবাদত করার তাওফিক দিন। পুরো সময় ঘরের ভেতর অবস্থানের তাওফিক দিন এবং সতর্ক ও সচেতনভাবে থাকার সুমতি দিন। আমীন।