“নতুন করে নিষেধাজ্ঞা আরোপের জন্য ট্রাম্পের নির্দেশ” নিউইয়র্কে বুলেট ট্রেনের গতিকেও হার মানিয়েছে করোনা

290

নিউইয়র্ক থেকে: রঙিন আকাশে করোনাভাইরাস যেন সবকিছু মলিন করে ফেলেছে। যুক্তরাষ্ট্রে বুলেট ট্রেনের গতিকেও হার মানিয়েছে আক্রান্ত ও মৃতের সংখ্যা। দিনদিন যে হারে এই সংখ্যা বাড়ছে সেখানে বেঁচে থাকার আশাটাই ফিকে হয়ে আসছে। এই নীরব ঘাতকের বিরুদ্ধে লড়াই করার মতো মনোবল খোদ চিকিৎসক, নার্সরাও হারিয়ে ফেলছেন।সবচেয়ে করুণ অবস্থা নিউইয়র্কে।

এমতাবস্থায় যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্ক, নিউজার্সি ও কানেকটিকাট রাজ্যে শক্ত ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞা আরোপের নির্দেশ দিয়েছেন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প।

করোনাভাইরাস তীব্রভাবে ছড়িয়ে পড়ায় আগে থেকেই লকডাউনে থাকা নিউইয়র্ক , নিউজার্সিতে নতুন করে ফেডারেল অবরোধের প্রস্তাব করেছিলেন প্রেসিডেন্ট।এতে রাজ্য গভর্নর এন্ড্রু ক্যুমোর তীব্র সমালোচনার মুখে পড়তে হয় তাঁকে।

প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প ২৮ মার্চ শনিবার সকালে তিনটি রাজ্যে ফেডারেল অবরোধ দেয়ার কথা জানালে তিন রাজ্যের গভর্নররা তীব্র প্রতিক্রিয়া জানান।

গভর্নর ক্যুমো বলেছেন, এর মানে কি ? প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের এমন আইনগত অধিকারই নেই। এমন ঘোষণা আসলে এ তিন রাজ্যের লোকজন নিজেদের রাজ্যে আটকা পড়বে। দেশের অন্য কোথাও যেতে পারবে না। পরে ট্রাম্প তাঁর আগের অবস্থান থেকে সরে এসে সেন্টার ফর ডিসিজ কন্ট্রোল এন্ড প্রিভেনশন( সিডিসি) কে এ তিন রাজ্যের উপর করা ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞা জারি করার নির্দেশ দিয়েছেন।

আমেরিকার ম্যাসাচুসেটস , ফ্লোরিডা , রোড আইল্যান্ডসহ বেশ কিছু রাজ্য গভর্নররা এরমধ্যেই নিজেদের রাজ্যে বাহির থেকে আসা লোকজনকে ১৪ দিনের স্বেচ্ছা কোরান্টাইনে থাকার নির্দেশ দিয়েছেন। রোড আইল্যান্ডে নিউইয়র্কের গাড়ির নাম্বার প্লেট দেখলেই আটকানো হচ্ছে। লোকজনকে পরীক্ষা নিরীক্ষা করা হচ্ছে। এ নিয়ে নিউইয়র্কের গভর্নর বলেছেন, আইন অনুযায়ী নিউইয়র্কের লোকজনের যাতায়াতকে বাধাগ্রস্থ করার এমন সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে প্রয়োজনে ফেডারেল আদালতে তিনি মামলা করবেন।

বিপর্যস্থ নিউইয়র্কের জন্য মার্কিন নৌবাহিনীর ভাসমান হাসপাতাল পাঠিয়ে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প নিউইয়র্কবাসীর উদ্দ্যশ্যে বলেছেন, আমরা সঙ্গে আছি এবং শেষ পর্যন্ত পাশে থাকবো। যুদ্ধজাহাজটি সোমবারেই ম্যানহাটনের পিআর ৯০ জালাধারে এসে পৌঁছাবে। মঙ্গলবার থেকে করোনাভাইরাস নয়, এমন রোগীদের চিকিৎসা দেয়া হবে। জ্যাভিট সেন্টারসহ নিউইয়র্কের হোটেল, নার্সিং হোম এবং এক্সপো সেন্টারে নির্মিত অস্থায়ী হাসপাতালগুলোতে অন্যান্য রোগীদের স্থানান্তর করা হচ্ছে নিয়মিত হাসপাতালে করোনা আক্রান্তদের স্থান সংকুলানের জন্য।

আইসিইউতে থাকা করোনাভাইরাসে আক্রান্ত রোগীদের চিকিৎসা দেয়ার হৃদয়বিদারক বর্ণনা দিয়েছেন নিউইয়র্ক ইউনিভার্সিটি ল্যাংগন মেডিকেল সেন্টার অ্যান্ড বেলভ্যুর চিকিৎসক ডা. কামিনী দ্যুবে। তিনি বলেন, করোনাভাইরাসে আক্রান্ত রোগীরা খুব কঠিন সময় পার করছেন। তারা বেঁচে থাকার লড়াই করছেন প্রতি মুুহূর্তে। কিন্তু প্রাণঘাতী এ ভাইরাসের সংক্রমণ প্রতিরোধে পরিবারের কারোর সঙ্গে তাদেরকে দেখা করতে দেয়া হচ্ছে না।

ড. দ্যুবে বলেন, প্রায়ই এমন দেখতে পাচ্ছি যে, একজন করোনা আক্রান্ত রোগী মৃত্যুশয্যায়, তিনি মারা যাচ্ছেন কিন্তু তার পাশে কেউ নেই। যাদেরকে আইসিইউতে রাখা হচ্ছে, তাদের স্বজনদের ভোগান্তি দেখে খুবই কষ্ট হচ্ছে। আইসিইউতে চিকিৎসাধীন রোগীরা তাদের পরিবারের লোকজনের সঙ্গে ফোনে কান্নাকাটি করছেন। তাদের চোখের পানি দেখা খুবই বেদনাদায়ক। আবার এমন অনেকেই আছেন যারা মৃত্যুর সময় পরিবারের কাউকেই পাশে পাচ্ছেন না। এটা খুবই মর্মান্তিক।

এছাড়া বাংলাদেশি-আমেরিকান বংশোদ্ভূত চিকিৎসক ডা. আনামুর রহমান জানান, অবস্থা ভালো নয় নিউইয়র্ক হাসপাতালগুলোর। লাশের সংখ্যা বাড়ছে। এই সংখ্যা আরো এক মাস পর্যন্ত বাড়বে বলে তিনি সতর্ক করে ঘরে থাকার আহ্বান জানান।

নিউইয়র্কে গত তিন দিনে ৭৯০ ভেন্টিলেটর শহরের বিভিন্ন হাসপাতালে প্রেরণ করা হয়েছে। সিটি মেয়র ও ফেডারেল সরকারের দেয়া ২,০০০ ভেন্টিলেটরের মধ্যে প্রায় অর্ধেক বিতরণ করা হয়েছে। আগামীকাল শহরে আরও ৬০০ টি ভেন্টিলেটর সরবরাহ করবে।

গত সপ্তাহে মেয়র ব্লাজিও ফেডারেল সরকারের কাছ থেকে মোট ১৫ হাজার ভেন্টিলেটর অনুরোধ করার পরে এটি আসে।

করোনাভাইরাসে এখন পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্রে ১ লাখ ২৩ হাজার ৭৫০ জন আক্রান্ত হয়েছেন। আর প্রাণ গেছে ২২২৭ জনের। নিউইয়র্কে ৫৩ হাজার ৪৫৩ জন আক্রান্ত হয়েছেন। আর প্রাণ গেছে ৮৮৩ জনের।
মৃত্যুর মিছিলের দীর্ঘ এই লাইনে বাংলাদেশিরাও আছেন। নিউইয়র্কে করোনাভাইরাসের ভয়াল থাবায় মোট ১১ জন প্রাণ হারিয়েছেন। প্রথম আলো উত্তর আমেরিকা এ তথ্য নিশ্চিত করেছে।

করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি আছেন নিউইয়র্কের অনেক সংবাদকর্মী সহ কমিউনিটির পরিচিতজন। সর্বশেষ সাংবাদিক ফরিদ আলম ও আলোকচিত্রী স্বপন হাই আক্রান্ত হয়েছেন। স্বপন হাই কিডনি জটিলতা রোগে দীর্ঘদিন ধরে ভুগছিলেন।

ফিলাডেলফিয়ার টেম্পল ইউনিভার্সিটির মেডিসিনের অধ্যাপক ডাঃ জিয়াউদ্দিন আহমেদ বলেছেন, নিউইয়র্কের ৪০% ভাগ করোনা রোগী যে হাসপাতলে যায় তার ক্রিটিকাল কেয়ার ইউনিটের একজন ডাক্তারের অভিজ্ঞতা এবং ফিলাডেলফিয়ার সবচেয়ে বেশি করোনা রোগী আমাদের হাসপাতালে থাকার কারণে আমেরিকার গত তিন সপ্তাহে এই রোগ সম্পর্কে কিছু স্পষ্ট ধারণা তৈরি হয়েছে। তিনি বলেন, (কোভিড- ১৯) করোনাভাইরাস সাধারণ ফ্লু জাতিরই ভাইরাস। তবে আগে কোনোদিন মানুষের শরীর এটিকে দেখেনি সে জন্য শরীরের প্রতিরোধের সিস্টেম অতিরিক্তভাবে এটাকে আক্রমণ করতে যেয়ে ফুসফুসের অপূরণীয় ক্ষতি সাধন করতে পারে।

মানুষ ভাইরাসের সংস্পর্শে আসার সাত থেকে ১৪ দিনের মধ্যে (কোভিড- ১৯) রোগে আক্রান্ত হয়। এটা হলেও ৮০ ভাগ সময় কিছুদিনের সামান্য শরীরের অস্বস্থিকর অনুভতি, কিছু হালকা মাথা ব্যাথা ও কাশি থাকতে পারে। তারপর ভালো হয়ে যায়। সম্পূর্ণ ভালো হতে ,৫, ৭ অথবা ১৫ দিন লাগতে পারে। যারা ভালো হন না, তাদের শ্বাস কস্ট শুরু হয় এবং তাদের অনেকের বাসায় থাকলেও শ্বাসকষ্ট কমে যায়। না কমলে তাদের হাসপাতালে যেতে হয় অক্সিজেন নেয়ার জন্য এবং তাদের যদি আরো খারাপ অবস্থা হয় তখন ভেন্টিলেটর সাহায্য লাগবে। তবে ১০ থেকে ১২ দিনেই অনেকেই ভেন্টিলেটোর থেকে ভালো হয়ে যাবেন। আর ১ থেকে ২ শতাংশ লোক মারা যাবেন। তাই আজকাল নিউইয়র্কে করোনাতে জ্বর , কাশি , দূর্বলতা ,গায়ে ব্যাথা হলেও শ্বাসকষ্ট না হলে হাসপাতলে সেই রোগীকে ভর্তি করবে না। তাঁদের ইমার্জেন্সি রুম থেকে বাড়িতে ফেরত পাঠাবে।

Leave A Reply

Your email address will not be published.