নতুন আরও ২২ পণ্য বাজার থেকে প্রত্যাহারের নির্দেশ

347

ঢাকা: দ্বিতীয় দফায় আরও ২২টি পণ্যকে ‘নিম্নমানের’ বলে ঘোষণা করেছে জাতীয় মান নির্ধারণকারী সংস্থা-বিএসটিআই। আগামী ৭২ ঘণ্টার মধ্যে বাজার থেকে পণ্যগুলো তুলে নিতে কোম্পানিগুলোকে মঙ্গলবার নির্দেশ দেয় সংস্থাটি।

সেইসঙ্গে পণ্যগুলোর বিক্রি-বিতরণ ও বাণিজ্যিক বিজ্ঞাপন প্রচারেও নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়।

তালিকাভুক্ত পণ্যগুলোর মধ্যে কয়েকটি বেশ জনপ্রিয় হওয়ায় উদ্বেগের মধ্যে আছেন সাধারণ ভোক্তারা।

মিরপুরের বাসিন্দা জাহানারা বেগম জানান, “কয়েকটা পণ্য দেখলাম লিস্টে, সেগুলো আমি রেগুলার রান্নায় ব্যবহার করি।”

“এখন ভাল ব্র্যান্ডগুলোর বিরুদ্ধেও যদি মান নিয়ে প্রশ্ন ওঠে, আমরা সাধারণ মানুষ কোথায় যাব, কি খাব? এটা তো প্রতারণা!”

এ ব্যাপারে সরকারের নিয়মিত ও কড়া নজরদারির প্রয়োজন বলে তিনি মনে করেন।

একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা নাদিয়া হক উদ্বেগ প্রকাশ করে বিবিসি বাংলাকে বলেছেন, খাবারের সাথে আমাদের হেলথ (স্বাস্থ্য) ইস্যু জড়িত।

“এই খাবার যদি নিম্নমানের হয়, তাহলে মানুষ কাদের উপর আস্থা রাখবে?”

তিনি বলেন, “হেলথের [স্বাস্থ্যের] সাথে কোন কমপ্রোমাইজ চলে না।”

রমজান মাস উপলক্ষে খোলা বাজার থেকে ৪০৬টি পণ্যের নমুনা সংগ্রহ করে সেগুলোর মান পরীক্ষা করে বিএসটিআই।

প্রথম ধাপে ৩১৩টি পণ্যের মান পরীক্ষার পর ৫২টি পণ্যকে নিম্নমানের বলে ঘোষণা করে তারা। পরে কয়েকটি পণ্য মানের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হলে তাদের উপর নিষেধাজ্ঞা তুলে নেয় বিএসটিআই।

এরপর দ্বিতীয় দফায় অবশিষ্ট ৯৩টি পণ্যের মান পরীক্ষা করে প্রতিষ্ঠানটি। সেখানে নতুন করে উঠে আসে ২২টি পণ্যের নাম।

নির্দিষ্ট সময়সীমার মধ্যে পণ্যগুলো বাজার থেকে তুলে নেয়া না হলে বিভিন্ন অংকের জরিমানার পাশাপাশি বিএসটিআই এর আইনের আওতায় প্রতিষ্ঠানগুলোর বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে বলে জানান বিএসটিআই-এর পরিচালক (সিএম) ইসহাক আলী।

নিম্নমানের অভিযোগ ওঠা পণ্যের তালিকা:

১. হাসেম ফুডসের কুলসন লাচ্ছা সেমাই

২. ঝালকাঠির জে কে ফুড প্রোডাক্টের মদিনা লাচ্ছা সেমাই

৩. প্রাণ ডেইরির প্রাণ প্রিমিয়াম ঘি

৪. এগ্রো অর্গানিকের খুশবু ঘি

৫. চট্টগ্রামের যমুনা কেমিক্যাল ওয়ার্কসের এ-৭ ঘি

৬. চট্টগ্রামের কুইন কাউ ফুড প্রোডাক্টসের গ্রিন মাউন্টেন বাটার অয়েল

৭. স্কয়ার ফুড অ্যান্ড বেভারেজের রাঁধুনী ধনিয়া গুড়া

৮. স্কয়ার ফুড অ্যান্ড বেভারেজের রাঁধুনী জিরার গুড়া

৯. থ্রি স্টার ফ্লাওয়ার মিলের থ্রি স্টার হলুদের গুড়া

১০. চট্টগ্রামের কনফিডেন্স সল্টের কনফিডেন্স আয়োডিনযুক্ত লবণ

১১. এস এ সল্টের মুসকান আয়োডিনযুক্ত লবণ

১২. চাঁদপুরের বিসমিল্লাহ সল্ট ফ্যাক্টরির উট আয়োডিনযুক্ত লবণ

১৩. চাঁদপুরের জনতা সল্ট মিলসের নজরুল আয়োডিনযুক্ত লবণ

এর মধ্যে থ্রি স্টার ফ্লাওয়ার মিল ও এগ্রো অর্গানিকের ওই পণ্য দুটি নিম্নমানের হওয়ায় প্রতিষ্ঠান দুটির লাইসেন্স বাতিল করে বিএসটিআই। ১১টি পণ্যের লাইসেন্স এর উপর স্থগিতাদেশ দেয়া হয়েছে।

এছাড়া বিএসটিআই-এর কোনও লাইসেন্স ছাড়াই বাকি আটটি পণ্য বাজারজাত করায় সেগুলোর বিরুদ্ধে নিয়মিত মামলা করার কথা জানিয়েছে সংস্থাটি। একটি প্রতিষ্ঠানের (ড্যানিশ ফুডস লিমিটেড, নারায়ণগঞ্জ) লাইসেন্স আগেই বাতিল করা হয়েছে।

প্রথম দফায় ৫২টি পণ্যের নতুন করে পরীক্ষার ফলাফল: প্রথম দফায় যে ৫২টি পণ্য কে নিম্নমান হিসেবে প্রমাণিত হয়েছিল সেগুলোর মধ্যে ৪৩টি পণ্যের লাইসেন্স স্থগিত করা হয়েছিল। বাকি নয়টি পণ্যের লাইসেন্স বাতিল করা হয়েছিল।

আর লাইসেন্স স্থগিতকৃত পণ্যের ৪২টি পণ্যের মধ্যে ২৬টি পণ্য পরবর্তী মান পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়ায় তাদের লাইসেন্স স্থগিতাদেশ প্রত্যাহার কথা জানায় বিএসটিআই।

লাইসেন্স বাতিল করা হয় ১৬টি পণ্যের।

মঙ্গলবার এক বিজ্ঞপ্তিতে তারা সেই প্রতিষ্ঠানগুলোর তালিকা তুলে ধরে।

যেসব পণ্যের লাইসেন্স স্থগিতাদেশ প্রত্যাহার করা হয়েছে:

১. দিঘী ড্রিংকিং ওয়াটার।

২. আররা ড্রিংকিং ওয়াটার

৩. এসিআই পিওর আয়োডিনযুক্ত লবণ

৪.এসিআই পিওর ধনিয়া গুড়া

৫. ফ্রেশ হলুদের গুড়া

৬. মঞ্জিল হলুদের গুড়া

৭. ডলফিন হুলুদের গুড়া

৮. ডলফিন মরিচের গুড়া

৯. সূর্য মরিচের গুড়া

১০. শান হলুদের গুড়া

১১. প্রাণ কারি পাউডার

১২. মধুমতি আয়োডিনযুক্ত লবণ

১৩. ডুডলস নুডলস

১৪. তীর সরিষার তেল

১৫. জিবি সরিষার তেল

১৬. বাঘাবাড়ি স্পেশাল ঘি

১৭. গ্রিন ল্যান্ডস মধু

১৮. রূপসা ফার্মেন্টেড মিল্ক

১৯. মধুবন লাচ্ছা সেমাই

২০. ওয়েলফুড লাচ্ছা সেমাই

২১. মিঠাই লাচ্ছা সেমাই

২২. মধুফুল লাচ্ছা সেমাই

২৩. মেহেদি বিস্কুট

২৪. মক্কা চানাচুর

২৫. কিং ময়দা

২৬. নিশিতা সুজি

লাইসেন্স বাতিল করা হয়েছে যে পণ্যগুলোর:

১. মিষ্টিমেলা লাচ্ছা সেমাই

২. প্রাণ লাচ্ছা সেমাই

৩. ফ্রেশ লাচ্ছা সেমাই

৪. অমৃত লাচ্ছা সেমাই

৫. জেদ্দা লাচ্ছা সেমাই

৬. তিন তীর আয়োডিনযুক্ত লবণ

৭. মদিনা, স্টারশিপ আয়োডিনযুক্ত লবণ

৮. তাজ আয়োডিনযুক্ত লবণ

৯. মোল্লা সল্টের আয়োডিনযুক্ত লবণ

১০. দাদা সুপার আয়োডিনযুক্ত লবণ

১১. নূর স্পেশাল আয়োডিনযুক্ত লবণ

১২. প্রাণ হলুদ গুড়া

১৩. ড্যানিশ কারি পাউডার।

১৪. ড্যানিশ হলুদের গুড়া

১৫. ডানকান ন্যাচারাল মিনারেল ওয়াটার

১৬. পুষ্টি সরিষার তেল

১৭. সান চিপস

লাইসেন্স স্থগিতাকৃত প্রতিষ্ঠানসমূহ:

১. প্রাণ প্রিমিয়াম ঘি
২. এ -সেভেন ঘি
৩. গ্রিন মাউন্টেইন বাটার ওয়েল
৪. রাঁধুনী ধনিয়ার গুড়া
৫. জিরার গুড়া
৬. কুলসন লাচ্ছা সেমাই
৭. মদিনা লাচ্ছা সেমাই
৮. মুসকান আয়োডিনযুক্ত লবণ
৯. কনফিডেন্স আয়োডিনযুক্ত লবণ
১০. উট আয়োডিনযুক্ত লবণ
১১. নজরুল আয়োডিনযুক্ত লবণ

কী বলছে বিএসটিআই এবং জাতীয় ভোক্তা অধিকার ও সংরক্ষণ অধিদফতর: বিএসটিআই এর এ ধরণের অভিযান নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন জাতীয় ভোক্তা অধিকার ও সংরক্ষণ অধিদফতরের মহা পরিচালক মোহাম্মদ শফিকুল ইসলাম লস্কর।

বিবিসি বাংলাকে তিনি বলেন, “বিএসটিআই তো মাঝেমাঝেই এরকম করে।… এই যেমন ৫২টা পণ্যকে প্রথমে নিম্নমানের বলার আগে তারা হয়তো দ্বিতীয়বার পরীক্ষা করে ডিসিশন দিতে পারতো। এইভাবে পণ্য ধ্বংস করা হলে তো সবকিছুর দাম বেড়ে যাবে।”

এ ব্যাপারে বিএসটিআই এর পরিচালক (সিএম) ইসহাক আলী জানান, তারা প্রত্যেকটা পণ্য বিএসটিআই এর স্ট্যান্ডার্ড অনুযায়ী যথাযথ আছে কিনা সেটাই তারা যাচাই করে দেখেন।

যেসব পণ্যের স্ট্যান্ডার্ড প্যারামিটারে অসামঞ্জস্যতা পাওয়া গেছে সেগুলোকেই বাজার থেকে প্রত্যাহারের নির্দেশ দেয়া হয় বলে তিনি জানান।

তবে কোন পণ্যকেই স্থায়ীভাবে বাতিল করা হয়নি উল্লেখ করে মিস্টার আলী বলেন, “আমরা প্রতিটি প্রতিষ্ঠানকে সুযোগ দিয়েছি। যেন তারা পুনরায় মান উন্নয়ন করতে পারে।”

“পরবর্তী পরীক্ষায় তারা উত্তীর্ণ হলে তারা আবার নিজেদের পণ্য বাজারে ছাড়তে পারবেন। তখন তাদের ওপর থেকে সাময়িক নিষেধাজ্ঞা তুলে নেয়া হবে।”

“তবে দ্বিতীয় দফার পরীক্ষাতেও যদি তারা অকৃতকার্য হয় তাহলে স্থায়ীভাবে নিষেধাজ্ঞা জারি করা হতে পারে।” জানান মিস্টার আলী।

এদিকে বিএসটিআই- মান পরীক্ষা করে যে পণ্যগুলোকে নিম্নমানের বলে দাবি করেছে, সেসব প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের কথাও জানান জাতীয় ভোক্তা অধিকার ও সংরক্ষণ অধিদফতরের মহাপরিচালক মোহাম্মদ শফিকুল ইসলাম লস্কর।

তিনি বলেন, “আমরা প্রাথমিকভাবে পণ্যগুলো তুলে নিতে পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তি দেব। এরপর জেলা পর্যায়ের কর্মকর্তারা অভিযান চালানো হবে। সেখানে কোথাও এমন পণ্য পাওয়া গেলে তা ধ্বংস করা হবে।”

এছাড়া প্রতিষ্ঠানগুলোকে জরিমানার পাশাপাশি যেসব দোকান এসব পণ্য বিক্রি করছে সেগুলোকে সাময়িক বন্ধ করা হতে পারে বলেও তিনি উল্লেখ করেন।

তবে বার বার যেসব প্রতিষ্ঠানের পণ্যের নাম উঠে আসছে তারা যদি বেশি লাভ করার আশা বাদ দিয়ে সততার সাথে মানসম্পন্ন পণ্য উৎপাদন করে তাহলে ভোক্তারা তাদের ওপর পুনরায় আস্থা ফিরে পাবে বলে মনে করেন মিস্টার লস্কর।

অন্যদিকে ইসহাক আলী বলেছেন, “এসব অভিযানে ক্রেতা ভোক্তাদের সচেতনতা বাড়লেও ব্যবসায়ীদের নৈতিক চরিত্রে পরিবর্তন না হলে কোন লাভ হবে না।” সূত্র: বিবিসি বাংলা

Leave A Reply

Your email address will not be published.