‘একদিন প্রধানমন্ত্রীকে ঝালমুড়ি খাওয়াইতে চাই’
গায়ে ফরমাল শার্ট, গলায় টাই, পায়ে সু, চোখে চশমা, কানে ইয়ারফোন। তিনি কোনো কর্পোরেট অফিসার নয়, রাজধানীর শাহবাগে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের সামনে বসা একজন ঝালমুড়ি বিক্রেতা। নাম তার জুলহাস হাওলাদার। সবার কাছে টাই-ঝালমুড়ি মামা বলেই পরিচিত তিনি। এ ছাড়া, তার মুড়ির বস্তাতে লাগানো আছে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ছবি ও তার বাবার মুক্তিযোদ্ধার সনদপত্র।
জুলহাসের বাবা ছিলেন বীর মুক্তিযোদ্ধা। বাবা মারা যাওয়ার পর সংসারের সমস্ত দায়িত্ব পড়ে তার ওপর। মা আর ভাই-বোনদের নিয়ে কতদিন আর কতরাত অনাহারে, অর্ধাহারে কেটেছে জুলহাসদের জীবন। তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে অসুস্থ প্রতিবন্ধী শিশু ছেলেকে সুস্থ করার সংগ্রাম। কথা হয় তার সঙ্গে-
* আপনি টাই পরে ঝাল মুড়ি বিক্রি করেন কেন? সাধারণত আপনার মতো পোশাক পরে কেউ ঝাল মুড়ি করে না।
** সুন্দর পোশাক, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা আমার কাছে ডিজিটালের একটা অংশ। দেশের সব জায়গায় সরকার ডিজিটাল করছে। আমি ক্যান ডিজিটাল হবো না। আমার কথা হচ্ছে, ‘এগিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ, জুলহাস কেন পিছিয়ে থাকবে?’
* এতে আপনার বিক্রি বেড়েছে?
** জি। তবে, অফিস-আদালত বন্ধ থাকলে কম হয়।
* এমন পোশাক পরে ঝালমুড়ি বিক্রি করতে আপনার কেমন লাগে?
** বাসে বা ফুটপাত দিয়ে যাওয়ার সময় মানুষ যখন আমার দিকে তাকিয়ে থাকে, তখন আমার খুব ভালো লাগে। ঝালমুড়ি বিক্রির সময় আত্মীয়-স্বজন বা এলাকার মানুষের সঙ্গে দেখা হলে লজ্জা লাগে। লজ্জা লাগলে ভাবি, চুরি কইরা তো খাই না, রোজগার কইরা খাই।
* আপনি কি প্রতিদিন একই পোশাক পড়েন?
** না। আমার এক রঙের ৯টা শার্ট আছে। একটা শার্ট দুই দিন করে পরি। টাই আছে ৩০ থেকে ৩৫টা। তিন চার মাসের মাথায় জুতাও পাল্টাই। আমার শুধু পোশাকেই ফুটানি। আর কিছু নাই। ভেতরে পুরাই ফাঁকা।
* পড়াশোনা করেছেন কি?
** অভাব-অনটনের কারণে পড়াশোনাটা আর করা হয় নাই। তাতে আমার দুঃখ নাই। তবে, কেউ কেউ আমাকে দেখে ভাবে, উচ্চ শিক্ষিত বেকার আমি, চাকরি না পেয়ে বাধ্য হয়েই ঝালমুড়ি বিক্রি করতাছি।
* আপনি কত দিন যাবৎ ঢাকায় আছেন?
** প্রায় ২৫ বছর হবে। আর আট বছর ধইরা ঝাল মুড়ি বেচতাছি।
* ঢাকা এসেই কি ঝাল মুড়ি বিক্রি শুরু করেন?
** প্রথম শুরু করি পান-সিগারেট বেচা। এরপর মাছ বেচা থেকে শুরু করে ইট ভাঙ্গার কাজসহ নানা কাজ করছি।ঢাকায় আইসাও অনেক কষ্ট করছি। না খেয়ে থাকছি অনক দিন।
* আপনার বাবার মুক্তিযুদ্ধের সনদপত্র মুড়ির দোকানে লাগিয়ে রেখেছেন কেন?
** নিজেকে মুক্তিযোদ্ধার সন্তান হিসেবে পরিচয় দিতে গর্ববোধ করি। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছিল বাবা তসলিম হাওলাদার। আমাদের গ্রামে আমার বাবাই একমাত্র মুক্তিযোদ্ধা। যুদ্ধের সময় ভারতে গিয়ে প্রশিক্ষণ নিয়েছিল। দেশের জন্য যুদ্ধ করছে, দেশ স্বাধীন করছে। এমন বাবার সন্তান হওয়া সকলের জন্যই ভাগ্যের ব্যাপার। তাই বাবার মুক্তিযুদ্ধের সার্টিফিকেট সব সময় লাগিয়ে রাখি।
* বঙ্গবন্ধু ছবি সঙ্গে রাখেন কেন?
** বঙ্গবন্ধুর প্রতি শ্রদ্ধাবোধ ও বাবার আদেশ মানতে আমার দোকানে রাখি। প্রতিদিন ২০ টাকা দিয়ে ফুলের মালা কিনে তার ছবিতে দেই। বাবা মারা যাওয়ার আগে বলেছিল, যার জন্য এ দেশ স্বাধীন হয়েছে তাকে কোনদিনও ভুলে যাইস না। তাই বঙ্গবন্ধুর ছবি সঙ্গে রাখি। এই ছবিটা দোকানে রাখার জন্য মার খাইছি অনেক।
* ফুটপাতে দোকান নিয়ে বসতে কি হয়রানির শিকার হচ্ছেন?
** আগে হয়রানির শিকার হইতাম। এখন হই না। আাগে অনেকেই ফ্রি ঝাল মুড়ি খাইত। চাঁদা চাইতো। বাবার মুক্তিযোদ্ধের সার্টিফিকেট রাখার কারণে এখন কেউ ফ্রি মুড়ি খায় না।
‘একদিন প্রধানমন্ত্রীকে ঝালমুড়ি খাওয়াইতে চাই’
* আপনার গ্রামের বাড়ি কোথায়?
** শরীয়তপুর জেলার ডামুড্যা উপজেলার ধানকাটি গ্রামে।
* ঢাকায় কোথায় থাকেন?
** বসুন্ধরা শপিং কমপ্লেক্সের পেছনে একটা ভাড়া বাসায়।
* বাসায় আপনার কে কে আছেন?
** মা, তিন সন্তান ও আমার স্ত্রী।
* আপনার সন্তানরা কি পড়াশোনা করে?
** মেয়ে জিতনী ক্লাস ফাইবে পড়ে। ছোট ছেলেটার কোলের। স্কুলে যাওয়ার সময় হয় নাই। বড় ছেলে সুলাইমান প্রতিবন্ধী। ক্লাস ফাইবে উঠার পর এক রোগে সে প্রতিবন্ধী হইয়া পড়ে। না হইলে সেভেনে পড়ত। টাকার অভাবে ছেলেটারে চিকিৎসা করাইতে পারছি না।
* কী হয়েছে তার?
** সে দাঁড়াইতে পারে না। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব হাসপাতালের এক ডাক্তারের কাছে অনুরোধ করার পরে তিনি একটা হুইল চেয়ার দিসে। ওই চেয়ারে কইরা সে চেলাফেরা করে।
* চিকিৎসা করাননি?
** টাকা পামু কোথায়? মুড়ি বেইচ্চ যা পাই, তাতে ঘর ভাড়া দিয়ে খাওয়ার খরচ চালাইতেই কষ্ট হয়। অনেক দিন না খাইয়া থাকছে আমার ছেলে। সেই দিনকার কথা কই, ঘরে শুধু ডাল আর ভাত। এ জন্য আমার ছেলে খায় নাই। একই জিনিস কত খাওয়া যায়? টাকার অভাবে ছেলেটারে একটু মাছ-মাংস খাওয়াইতে পারি না। ডাক্তার বলছে, ওরে ভিটামিন জাতীয় খাবার খাওয়াইতে। ওইটা কি আমার পক্ষে সম্ভব। আপনিই কন? ছেলেকে নিয়া আমি খুব কষ্টে আছি।
* মুড়ি বিক্রি করে আপনি প্রতিদিন কত আয় করেন?
** গড়ে প্রতিদিন ৩০০-৬০০টাকা থাকে। এই টাকায় চলতে আমার কষ্ট হয়।
* আপনারা কয় ভাই-বোন?
** পাঁচ ভাই ও এক বোন। আমি মেঝো।
* আমার মনে হচ্ছে আপনার এক চোখে সমস্যা?
** হ্যাঁ। বাম চোখে সমস্যা। একটু কম দেখি। কানেও কম শুনি।
* গ্রাম ছেড়েছেন কেন?
** অভাব আর অনটনের সংসার না চালাতে না পাইড়া ঢাকায় আসি। বাবাকে মাইরা ফালানোর পর সংসার চালানোর দায়িত্ব পড়ে আমার ওপর। মানুষের বাড়িতে কাজ করে অর্ধাহারে-অনাহারে জীবন কাটাছি। কখনও কখনও গরুর খাবার কুড়া খাইয়া থাকছি।
* আপনার বাবাকে কে মেরেছে?
** জমি সংক্রান্ত জেরে ২০০৭ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে মিথ্যা মামলা দিয়ে ক্রসফায়ারে আমার বাবাকে মাইরা ফালাইছে। পরে জমি কিছুটা ফেরত পাইছি। কিন্তু বাবাকে ফেরত পাই নাই।
‘একদিন প্রধানমন্ত্রীকে ঝালমুড়ি খাওয়াইতে চাই’
* আপনার কানে ইয়ারফোন দেখা যাচ্ছে, আপনি কি গান শুনতে পছন্দ করেন?
** বিরহের গানই বেশি শোনা হয়। হিন্দি গানও শুনি। তবে গানের চেয়েও বেশি শুনি বঙ্গবন্ধুর ভাষণ।
* সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের আপনার দোকানে নাকি মুড়ি খেতে এসেছিলেন?
** হ্যাঁ। তিনি আইছিল। তিনি বঙ্গবন্ধু হাসপাতালের সামনে আইসা নিজে গাড়ি থেকে নাইমা আমার বানানো ঝালমুড়ি খাইছে। খুশি হয়ে দিয়ে গেছে এক হাজার টাকা। আমি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে একদিন ঝালমুড়ি খাওয়তে চাই- এটা আমার স্বপ্ন।
মুক্তিযোদ্ধার স্ত্রী হিসেবে নিয়মিত ভাতা পান জুলহাসের মা। পেয়েছেন জমিও। তাই নিজের জন্য আর কিছু চাওয়ার নাই তার। জুলহাসের একটাই চাওয়া- ছেলের চিকিৎসা। টাকার অভাবে চিকিৎসা করতে পারছেন না তিনি। সুস্থ করে ছেলেকে বাঁচিয়ে রাখাই তার একমাত্র প্রার্থনা।
সৌজন্যেঃ ইত্তেফাক