গার্মেন্টে নতুন মজুরি কাঠামো

301

ঢাকা: শ্রমিকদের একটানা বিক্ষোভের পর গার্মেন্ট খাতের নতুন ঘোষিত মজুরি কাঠামো সংশোধন করেছে সরকার। মালিক-শ্রমিক ও প্রশাসনের প্রতিনিধিদের নিয়ে গতকাল শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ে ‘ত্রিপক্ষীয়’ বৈঠকে এ সংশোধনের মাধ্যমে ছয়টি গ্রেডের বেতন আগের তুলনায় বাড়ানো হয়। এর আগে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা শনিবার রাতে শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী ও সচিব এবং পোশাক মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএ নেতাদের গণভবনে ডেকে আলোচনা করে মজুরি সমম্বয়ের নির্দেশ দেন। সেই নির্দেশনা অনুসারে গতকাল সন্ধ্যায় ত্রিপক্ষীয় বৈঠক থেকে নতুন সংশোধিত মজুরি কাঠামো ঘোষণা করা হয়।

এদিকে সংশোধিত কাঠামো নিয়ে শ্রমিক সংগঠনগুলোর মিশ্র প্রতিক্রিয়া পাওয়া গেছে। মালিক ও সরকার সম্পৃক্ত একটি পক্ষ একে বিজয় বলে আখ্যা দিচ্ছে। অপরদিকে রাজপথে আন্দোলনরত শ্রমিক নেতাদের অংশটি বলছে, খুব অল্প পরিমাণ অর্থ বৃদ্ধির মাধ্যমে শ্রমিকদের সঙ্গে ‘তামাশা’ করা হয়েছে। সংশোধনের পর প্রথম গ্রেডের একজন কর্মী এখন থেকে সব মিলিয়ে ১৮ হাজার ২৫৭ টাকা বেতন পাবেন। ২০১৮ সালের নতুন মজুরি কাঠামোর গেজেটে তা ছিল ১৭ হাজার ৫১০ টাকা। ২০১৩ সালের বেতন কাঠামোতে এই গ্রেডের মজুরি ছিল ১৩ হাজার টাকা। দ্বিতীয় গ্রেডের সর্বমোট বেতন ধরা হয়েছে ১৫ হাজার ৪১৬ টাকা। ২০১৮ সালে মজুরি কাঠামোর গেজেটে তা ১৪ হাজার ৬৩০ টাকা ছিল। ২০১৩ সালের বেতন কাঠামোতে এই গ্রেডের বেতন ছিল ১০ হাজার ৯০০ টাকা। তৃতীয় গ্রেডের সর্বমোট বেতন ঠিক হয়েছে ৯ হাজার ৮৪৫ টাকা। ২০১৮ সালের গেজেটে ৯ হাজার ৫৯০ টাকা করা হয়েছিল। ২০১৩ সালের বেতন কাঠামোতে ৬ হাজার ৮০৫ টাকা। চতুর্থ গ্রেডের সর্বমোট বেতন ধরা হয়েছে ৯ হাজার ৩৪৭ টাকা। ২০১৮ সালে মজুরি কাঠামোর গেজেটে তা ৯ হাজার ২৪৫ টাকা করা হয়েছিল। ২০১৩ সালের বেতন কাঠামোতে এই গ্রেডের বেতন ৬ হাজার ৪২০ টাকা। পঞ্চম গ্রেডে সর্বমোট বেতন ঠিক হয়েছে ৮ হাজার ৮৭৫ টাকা। ২০১৮ সালের গেজেটে ৮ হাজার ৮৫৫ টাকা করা হয়েছিল। ২০১৩ সালের বেতন কাঠামোতে এটি ছিল ৬ হাজার ৪২ টাকা। ষষ্ঠ গ্রেডের সর্বমোট বেতন ধরা হয়েছে ৮ হাজার ৪২০ টাকা। ২০১৮ সালে মজুরি কাঠামোর গেজেটে তা করা হয়েছিল ৮ হাজার ৪০৫ টাকা। ২০১৩ সালের বেতন কাঠামোতে তা ছিল ৫ হাজার ৬৭৮। আর সপ্তম গ্রেডের মজুরি সব মিলিয়ে ২০১৮ সালের গেজেটের মতোই ৮ হাজার টাকা রাখা হয়েছে। ২০১৩ সালের কাঠামোতে সর্বনিম্ন গ্রেডের বেতন ছিল ৫ হাজার ৩০০ টাকা।

পর্যালোচনার পর ঘোষিত কাঠামো অনুসারে, ডিসেম্বরে ঘোষিত গেজেটের তুলনায় প্রথম গ্রেডে বেতন বেড়েছে ৭৪৭ টাকা, দ্বিতীয় গ্রেডের বেড়েছে ৭৮৬ টাকা, তৃতীয় গ্রেডের ২০ টাকা, চতুর্থ গ্রেডের ১০২ টাকা, পঞ্চম গ্রেডের ২৫ টাকা এবং ষষ্ঠ গ্রেডের ১৫ টাকা বেড়েছে। ডিসেম্বরে ঘোষিত গেজেটের বেতন জানুয়ারিতে শুরু হলেই বিক্ষোভের সূচনা হয়েছিল। অবশ্য এবার সংশোধনের পর ২০১৩ সালের ঘোষিত কাঠামো থেকে এবার প্রথম গ্রেডে বেতন বেড়েছে ৫২৭৭ টাকা, দ্বিতীয় গ্রেডের বেড়েছে ৪৫১৬ টাকা, তৃতীয় গ্রেডের ৩০৪০ টাকা, চতুর্থ গ্রেডের ২৯২৭ টাকা, পঞ্চম গ্রেডের ২৮৩৩ টাকা এবং ষষ্ঠ গ্রেডের ২৭৪২ টাকা, সপ্তম গ্রেডে বেড়েছে ২৭০০ টাকা।

বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশী বলেন, ১০ তারিখে যখন আলোচনা হয়েছিল তখন শুধু ৩, ৪ ও ৫ নম্বর গ্রেড নিয়ে আলোচনা করার জন্য বলা হয়েছিল। কিন্তু আজ আমরা মালিক-শ্রমিক উভয় পক্ষের সঙ্গে আলোচনা করে বললাম, ১ থেকে ৫ পর্যন্ত করব, তাহলে ৬ কেন বাদ যাবে। এ জন্য আমরা ছয়টি গ্রেড সমন্বয় করে দিয়েছি। আগামী সাত দিনের মধ্যে সংশোধিত কাঠামোর গেজেট প্রকাশ করা হবে। তিনি বলেন, শ্রমিকদের অধিকাংশই ভাঙচুর চায় না। কাজ করতে চায়। আমি আশা করব, তারা সবাই শান্তিপূর্ণভাবে কাজে যোগ দেবেন।

বৈঠক শেষে বেতন কাঠামো সংশোধনের প্রস্তাবে মালিক ও শ্রমিকপক্ষের একাংশের  প্রতিনিধিরা স্বাক্ষর করেন। শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের সম্মেলন কক্ষে শ্রম প্রতিমন্ত্রী মন্নুজান সুফিয়ান, সংসদ সদস্য সালাম মুর্শেদী, শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের সচিব আফরোজা খান, বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সচিব মো. মফিজুল ইসলাম, বিজিএমইএর সভাপতি মো. সিদ্দিকুর রহমান, এফবিসিসিআইর সভাপতি মো. সফিউল ইসলাম মহিউদ্দিন, বিজিএমইএর সাবেক সভাপতি আতিকুল ইসলাম, হামিম গ্রুপের চেয়ারম্যান এ কে আজাদ, জাতীয় শ্রমিক লীগের কার্যকরী সভাপতি ফজলুল হক মন্টু, জাতীয় শ্রমিক লীগের মহিলাবিষয়ক সম্পাদক বেগম শামছুন্নাহার ভূঁইয়া, জাতীয় গার্মেন্টস শ্রমিক ফেডারেশনের সভাপতি আমিরুল হক আমিন, ইন্ডাস্ট্রিয়াল বাংলাদেশ কাউন্সিলের মহাসচিব সালাউদ্দিন স্বপন এবং শ্রমিক নেতা মন্টু ঘোষসহ মালিক-শ্রমিক নেতারা বৈঠকে অংশ নেন।

বাংলাদেশ পোশাক প্রস্তুত ও রপ্তানিকারক সমিতি-বিজিএমইএ সভাপতি সিদ্দিকুর রহমান গতকাল বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, নতুন করে ছয়টি গ্রেডের মজুরি কাঠামোতে যে পরিবর্তন এসেছে, তাও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশনার আলোকে হয়েছে। মালিকদের অনেক কষ্ট হলেও গতকাল ত্রিপক্ষীয় সভার সিদ্ধান্ত মেনে নিয়েছে বিজিএমইএ। আর শ্রমিক নেতারাও স্বাগত জানিয়েছেন। বৈঠকে উপস্থিত মালিক পক্ষের আরেক নেতা ও বিজিএমইএর সাবেক সভাপতি আতিকুল ইসলাম বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, গত এক দশকে যে হারে শ্রমিকদের বেতন বৃদ্ধি পেয়েছে তা একটি ইতিহাস। কিন্তু বেতন বৃদ্ধির পরও কেন শ্রমিকরা সন্তুষ্ট হচ্ছে না তা বোধগম্য নয়। আমরা নিজেদের সক্ষমতা অনুযায়ী শ্রমিকদের বেতন বৃদ্ধি করতে পারব আর ক্রেতারা পোশাকের জন্য দামও বৃদ্ধি করতে ইচ্ছুক নয়- এ বিষয়টিও মাথায় রাখতে হবে।

বৈঠকে উপস্থিত শ্রমিক পক্ষের প্রতিনিধি গার্মেন্টস শ্রমিক ফেডারেশনের সভাপতি আমিরুল হক আমিন সংশোধিত মজুরি কাঠামোকে স্বাগত জানিয়ে শ্রমিকদের কাজে ফেরার আহ্বান জানান। গত রাতে আমিরুল হক আমিন বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনার আলোকে পোশাক শ্রমিকদের আন্দোলনের মুখে মজুরি কাঠামোতে কিছু সংশোধনী আনা হয়েছে। আগামী দু-এক দিনের মধ্যেই নতুন গেজেট হবে। এটা পোশাক শ্রমিকদের একটা বিজয়। যদিও চাওয়া-পাওয়া অনুযায়ী পোশাক শ্রমিকদের দাবি পূরণ হয়নি। তিনি বলেন, মজুরি কাঠামোর ছয় নম্বর গ্রেডে সব মিলিয়ে মোট ২০ টাকা বেড়েছে। তবুও শ্রমিকদের কাজে ফেরা উচিত বলে মনে করেন এই শ্রমিক নেতা।

তবে গার্মেন্টস শ্রমিক ট্রেড ইউনিয়ন কেন্দ্রের সাধারণ সম্পাদক জলি তালুকদার বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, গতকাল ত্রিপক্ষীয় সভায় ঘোষিত সংশোধিত কাঠামোতে পোশাক শ্রমিকদের মুজরি দাবি মোতাবেক বাড়েনি। এতে শ্রমিকদের সঙ্গে তামাশা করা হয়েছে, যা খুবই দুঃখজনক। ছয় নম্বর গ্রেডে ২০ টাকা আর ৫ নম্বর গ্রেডে মাত্র ১৫ টাকা মজুরি বেড়েছে। 

সমাজতান্ত্রিক শ্রমিক ফ্রন্টের কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক রাজ্জেকুজ্জামান রতন বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, নতুন যে মজুরি কাঠামো ঘোষণা করা হয়েছে, সেখানে আপাতদৃষ্টিতে শ্রমিকদের বেসিক মজুরি হয়তো কিছু কম হবে বলে ধারণা করছি। কিন্তু বাড়তি মজুরিতে শ্রমিকদের আর্থিক সংকট আগের চেয়ে কমবে। তবে শ্রমিকদের মজুরি বৃদ্ধির ইস্যুতেও কেন প্রধানমন্ত্রীকেই হস্তক্ষেপ করতে হবে তা বোধগম্য নয়। আগেরবার যখন মজুরি বৃদ্ধি করা হয়েছিল তখন যদি এ বিষয়গুলো মাথায় রেখে মজুরি বৃদ্ধি করা হতো তাহলে এ সংকট হতো না। আমি মনে করি, গতবার যারা মজুরি বৃদ্ধির সঙ্গে জড়িত ছিলেন তাদের ষড়যন্ত্রের কারণেই শ্রমিক অসন্তোষ তৈরি হয়েছে। আর সবকিছুর মধ্যে শ্রমিকদের দোষ খোঁজার মানসিকতা থেকেও বেরিয়ে আসতে হবে।

শ্রমিকরা কাজে না ফিরলে মজুরি ও গার্মেন্টস বন্ধ : মজুরি সমস্যা সমাধানের দাবিতে আন্দোলনরত তৈরি পোশাক শ্রমিকদের কারখানায় গিয়ে উৎপাদন কাজে অংশ নেওয়ার আহ্বান জানিয়ে মালিকপক্ষ বিজিএমইএ সভাপতি সিদ্দিকুর রহমান বলেছেন, ‘কাজ না করলে মজুরি ও গার্মেন্টস বন্ধ, আর যদি আজ থেকে শ্রমিকরা কারখানায় কাজ না করেন, তা হলে কোনো মজুরি প্রদান করা হবে না (নো ওয়ার্ক, নো পে)। এর সঙ্গে ওই কারখানা শ্রম আইনের ১৩/১ ধারা মোতাবেক অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ করে দেওয়া হবে।’

গতকাল দুপুরে কারওয়ান বাজারে বাংলাদেশ পোশাক প্রস্তুত ও রপ্তানিকারক সমিতি (বিজিএমইএ) আয়োজিত সংবাদ ব্রিফিংয়ে তিনি এ কথা বলেন। এ সময় উপস্থিত ছিলেন বিজিএমইএ সাবেক সভাপতি আবদুস সালাম মুর্শেদী এমপি, ব্যবসায়ী-শিল্পপতিদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআই সভাপতি ও বিজিএমইএর সাবেক সভাপতি শফিউল ইসলাম মহিউদ্দিন, সংগঠনটির আরেক সাবেক সভাপতি আতিকুল ইসলাম প্রমুখ।

লিখিত বক্তব্য পাঠ করে বিজিএমইএ সভাপতি সিদ্দিকুর রহমান বলেন, শ্রমিকদের নতুন মজুরি কাঠামো বিষয়ে ভিন্নমত রয়েছে। সমস্যা সমাধানে সরকার গঠিত ত্রিপক্ষীয় কমিটি কাজ করছে। কমিটি মজুরি কাঠামোর কোথাও ব্যত্যয় হলে তার পুনর্বিবেচনা করবে। তার জন্য আন্দোলন, ভাঙচুর করার প্রয়োজন নেই। তিনি আরও বলেন, পোশাক শিল্পের পরিস্থিতি অস্থিতিশীল করার লক্ষ্যে একটি মহল চক্রান্ত করছে। যার ফলে নিরীহ শ্রমিকদের উসকানি দিয়ে ও ভয়-ভীতি দেখিয়ে কর্মবিরতি করতে প্ররোচিত করা হচ্ছে। মজুরি কাঠামো নিয়ে আন্দোলন করার যৌক্তিকতা নেই। এ বিষয়ে সরকার গঠিত ত্রিপক্ষীয় কমিটি কাজ করছে।

বিজিএমইএ সভাপতি শ্রমিকদের উদ্দেশে বলেন, শ্রমিকদের সরলতার সুযোগ নিয়ে একটি স্বার্থান্বেষী মহল শিল্পে আপনাদের ব্যবহার করে অরাজক পরিস্থিতি সৃষ্টির অপতৎপরতায় লিপ্ত রয়েছে, যা মোটেও কাম্য নয়। আপনাদের সরলতার সুযোগে দেশের অর্থনীতির প্রাণ ও প্রধান কর্মসংস্থানের খাত নিয়ে কেউ ছিনিমিনি খেলবে, তা হতে দেবেন না। এ খাতটি ধ্বংস হলে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হবেন শ্রমিকরা। তারা কর্মহীন হবেন। আপনাদের জন্য কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা হতে পারে, এমন কোনো খাত এখনো গড়ে ওঠেনি।

Leave A Reply

Your email address will not be published.