আফ্রিকায় বিবাহবিচ্ছেদ বাড়ছে, চাইছেন মেয়েরাই

336

আর্ন্তজাতিক ডেস্ক: কখনও গায়ে হাত তোলা তো দূরের কথা, চিৎকার-চেঁচামেচিও করেনি তোমার স্বামী। বিবাহ বহির্ভূত কোনো সম্পর্কও নেই লোকটার। তাহলে? তুমি বিবাহবিচ্ছেদ চাইছ কেন?

কোলের ছেলেকে দুধ খাওয়াচ্ছিল জালিকা। জালিকা আমাদু। পশ্চিম আফ্রিকার ছোট্ট দেশ নাইজারের বাসিন্দা। বয়স এখনও হয়নি। কোলে সদ্যোজাত আফান। বিচারকের প্রশ্নে চোখ তুলে তার মুখের দিকে তাকাল জালিকা। তারপরে চাপা স্বরে বলল, ‘আমার মন ভরে না হুজুর। বাপের থেকে বড় একটা লোক। আয়-রোজগার নেই ঠিকমতো। বিয়ের আগে কত মিষ্টি মিষ্টি কথা বলেছিল। আর এখন! আমি ওর সঙ্গে আর থাকব না।’ পাশ থেকে আর্তনাদ করে ওঠেন জালিকার মা। ‘হায় আল্লাহ, স্বামীর ঘর করবে না বউ, এ কেমন কথা। কী দিনই না দেখতে হল!’ জালিকা একা নয়। রীতিনীতির ঘেরাটোপে বন্দি পশ্চিম আফ্রিকার ছোট ছোট দেশগুলোতে এখনও মেয়েদের বিয়ে হয়ে যায় ১৫-১৬র মধ্যেই। বছর ঘুরতে না ঘুরতেই কোলে আসে সন্তান। তারপরে আরও কয়েকটা। বিয়ের আগে যদি বা কিছু পড়াশোনা বা হাতের কাজ শেখা হয়, বিয়ের পরে সেটা পুরোপুরি বন্ধ। অর্থনৈতিক ভাবে বিপর্যস্ত এই দেশে জালিকাদের মতো পরিবারে অভাব-অনটন নিত্যসঙ্গী। স্বামীর রোজগার নেই। কিন্তু তবু স্ত্রীকে রোজগার করতে বাইরে বার হতে দেবে না। সেই বদ্ধ পরিবেশ থেকে বেরিয়ে আসতে চান জালিকার মতো তরুণীরা। দ্বারস্থ হন আদালতের— বিবাহবিচ্ছেদের আবেদন জানিয়ে।

মুসলিম অধ্যুষিত নাইজারের মতো পশ্চিম আফ্রিকার বিভিন্ন দেশে বিবাহবিচ্ছেদ খুব একটা নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনা নয়। তিন তালাকের কোনো প্রথাও নেই এখানে। বিচ্ছেদের জন্য দ্বারস্থ হতে হয় আদালতের। কিছু দিন আগে পর্যন্ত বিচ্ছেদ চেয়ে আদালতে যেতেন পুরুষেরাই। কিন্তু গত কয়েক বছরে ছবিটা দ্রুত পাল্টেছে। 

জালিকা যে আদালতে গেলেন, সেখানকার বিচারক আলকালি ইসমায়েল জানালেন, এখন মাসে প্রায় পঞ্চাশ জন নারী বিচ্ছেদ চেয়ে আদালতে আসেন। বিচারকের কথায়, ‘এই সব কমবয়সি মেয়েরা আর সহ্য করতে চায় না। তারা জানে, আদালতই তাদের মুক্তি দিত পারবে।’

পশ্চিম আফ্রিকা নিয়ে কাজ করেন এমন সমাজতত্ত্ববিদদের মতে, পশ্চিম আফ্রিকায় ধীরে ধীরে এক ‘বিচ্ছেদের সংস্কৃতি’ তৈরি হচ্ছে। এবং সেই সংস্কৃতির কাণ্ডারি মেয়েরাই। নিজ়েরের ইসলামি অ্যাসোসিয়েশনের সচিব আলৌ হামা বললেন, ‘এখন কমবয়সি মেয়েরা হুট করে বিয়ে করতে চায় না। পড়াশোনা করে রোজগার করতে চায়। নিজের পায়ে দাঁড়িয়ে পছন্দের পুরুষকে বিয়ে করতে চায়। কিন্তু অনেক সময়েই পরিবারের চাপে তারা বিয়ে করতে বাধ্য হয়। কিছু প্রত্যাশা নিয়ে তারা বিয়েটা করে। আর সেই প্রত্যাশা পূরণ না হলে পরের পদক্ষেপ তো বিবাহবিচ্ছেদ।’

জালিকা মায়েদের প্রজন্ম অবশ্য এখনও ভাবতেও পারেন না, কোনো মেয়ে নিজের মুখে বলবে ‘আমি আর স্বামীর সঙ্গে থাকব না’। তারও তো ১৪ বছর বয়সে বিয়ে হয়েছিল, তিন গুণ বয়সের একটা লোকের সঙ্গে। পাঁচ দশক সেই স্বামীর সঙ্গেই ঘর করেছেন, যত দিন না বুড়ো চোখ বুঁজেছে। আট জন ছেলেমেয়েকে মানুষ করেছেন, সংসার টেনেছেন। কষ্ট যে হয়নি, তা নয়। তাই বলে স্বামীর ঘর ছেড়ে একা থাকা! আদালতে বসেই এসব কথা বলছিলেন জালিকার মা। 

পাশে বসা জালিকা অবশ্য সে সব বকুনিতে কান দিতে নারাজ। স্বামীর আপত্তি সত্ত্বেও সেলাই শেখার কাজ শিখেছে বিয়ের পরে। ছেলে কোলে বয়স্ক শিক্ষার ক্লাসও করেছে। জানে, কোনো না কোনো একটা কাজ ঠিক পেয়ে যাবে। মা রাগ করলেও তাকে যে তাড়িয়ে দেবেন না, সে ভরসাও আছে জালিকার। ছেলের জন্য যা খোরপোশ দেবে স্বামী, তার সঙ্গে নিজের রোজগার যোগ করে ঠিক চলে যাবে মা-ছেলেতে। স্বামীর ঘরে যে ভাবে থাকত, তার থেকে হয়তো ভাল ভাবেই। আর সব থেকে বড় কথা, নিজের মতো করে বাঁচার স্বাধীনতাটা তো পাওয়া যাবে। সূত্র: আনন্দবাজার 

Leave A Reply

Your email address will not be published.