টরন্টোয় ‘দ্য মিনিস্ট্রি অব আটমোস্ট হ্যাপিনেস’ নিয়ে আলোচনা
কানাডার টরন্টোয় দর্শন-সমাজ-সংস্কৃতি-বিজ্ঞান চর্চ্চা কেন্দ্র ‘পাঠশালা’র বিষয়ক নিয়মিত আলোচনায় অরুন্ধতী রায়ের ‘দ্য মিনিস্ট্রি অব আটমোস্ট হ্যাপিনেস’ বই এর উপর আলোচনা অনুষ্ঠিত হয়।
গত বৃহস্পতিবার এগলিনটন স্কোয়ারের টরন্টো পাবলিক লাইব্রেরিতে বইয়ের উপর আলোচনা করেন সেরীন ফেরদৌস। এতে বই প্রেমিক বিপুল সংখ্যক শ্রোতার সমাগম ঘটে। আসরটি সঞ্চালনা করেন ‘পাঠশালা’র সংগঠক ফারহানা আজিম শিউলী।
‘পাঠশালা’র বর্ষপূর্তির বিশেষ আয়োজন হিসেবে এবারের আসরে, গত সাত আসরের পোস্টার ও আলোচিত বইগুলোর ছবি প্রদর্শিত হয়।
বইয়ের ওপর আলোচনা করতে গিয়ে সেরীন ফেরদৌস বলেন, উপন্যাসে অরুন্ধতী এক বিস্তির্ণ জনজীবনের গল্প বলেছেন যেখানে টাকা-পয়সা, ক্লাস, বর্ণ, গোত্র, ধর্ম, সমাজ, রাষ্ট্রযন্ত্রের তৈরি করা খাঁচায় আবদ্ধ-মানুষগুলো দেয়ালের বাইরে আসতে চাইছে! প্রতিটা দেয়াল জ্বলছে- কখনো তা ভৌগোলিক সীমারেখা, যেমন কাশ্মীর, কখনো তা আদিবাসী অরণ্য, কখনো তা মাটির নিচের প্রাকৃতিক সম্পদ, সামাজিক লিঙ্গভেদ কখনো তা ব্যক্তির নিজের সঙ্গে নিজের অস্তিত্বের দ্বন্দ্ব! উপন্যাসের চরিত্রেরা খুঁজছে নিজেদের, খুঁজছে নিজেকে!
তিনি বলেন, ট্রান্সজেন্ডার আনজুম আর স্থপতি তিলোত্তমাকে ঘিরে এগিয়ে যাওয়া ‘দ্য মিনিস্ট্রি অব আটমোস্ট হ্যাপিনেস’ বইটির প্রতিটি মানুষই কোনো না কোনোভাবে রাজনৈতিক সংস্কৃতি দ্বারা প্রভাবিত। এর ভেতরেই মানুষ ছোট ছোট সুখ খুঁজে খুঁজে বাঁচে, নিজের মতো করে দেশ, জীবন, মুক্তি আর সম্পর্কের মানে খুঁজে নেয়। সমাজের সিলমারা ভূমিকা অস্বীকার করে মৃতদের গোরস্থানে এসে জীবনের তরে বাসা বাঁধে আনজুম; আইডেন্টিটি খুঁজতে থাকা নানা প্রান্তের কিছু মানুষও এসে জড়ো হয় সেখানে।
বইটিকে সমসাময়িকতার এক অনবদ্য দলিল হিসেবে মন্তব্য করে সেরীন ফেরদৌস বলেন, নিজ দেশের তো বটেই, এমনকি বৈশ্বিক রাজনীতি কি তীব্রভাবে, প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে সমাজের, বিশেষ করে নিচের তলার মানুষদের কিভাবে প্রভাবিত করে তার নির্মম ও তীব্র সুখের বর্ণনা পাঠককে ওই জগতেই থাকতে বাধ্য করে পাঠ চলাকালে। অরুন্ধতী নিজেই বলেন, একটি গোল্ডফিশের যৌনজীবনও রাজনৈতিক।
তিনি বলেন, ২০ বছর সময় পার করে ১০ বছর ধরে লেখা এ উপন্যাসে বার বার এই প্রশ্ন করেছেন তিনি, হাউ টু রাইট এ শ্যাটারড স্টোরি? টু বিকাম এভরিবডি। নো টু বিকাম এভরিথিং! হ্যাঁ, উপন্যাসের চরিত্ররা তাই মানুষের গণ্ডি ছাড়িয়ে প্রাণী, উদ্ভিদ, মৃত মানুষ ও প্রাণহীন অবজেক্টও। সবগুলো দেয়ালই পলকা, এপার-ওপার আসা যাওয়া চলে নিত্য!
সেরীন ফেরদৌস বলেন, বিশ্বের ৩০টির মতো দেশে একযোগে প্রকাশিত হওয়া এ উপন্যাসের শেষে তারা-জ্বলা এক রাতে ছোট্ট গুবরে পোকাটি চারপা আকাশের পানে দিয়ে শুয়ে আকাশকে ঠেকিয়ে রাখতে চায় পতন থেকে, কারণ ততদিনে মিস উদয়া জিবীন নামের ছোট্ট শিশুটি এসে গেছে ট্রান্সজেন্ডার আনজুমের কোলে! তাকে রাষ্ট্রযন্ত্রের কবল থেকে চুরি করে আনে কোনোদিন মা-হতে-না-চাওয়া তিলোত্তমা! কবরস্থানে মৃতদের পাশাপাশি জীবনের ফুলকিও জ্বলে ওঠে!
আলোচনায় তিনি বলেন, তাহলে সুখ কি? সুখের মন্ত্রণালয় কি? সুখ মুহূর্ত মাত্র, সুখ ক্ষণে ক্ষণে আসে, সুখ মোড়ে মোড়ে নানা রূপে আসে, সুখ এসেই হারিয়ে যায় আবার নতুনরূপে আসবে বলে। সুখের উৎস হতে পারে নিজেকে পাওয়া, নিজেকে জানা। সুখ হতে পারে নিজের চারপাশের সমস্ত দেয়ালে আগুন লাগিয়ে দেয়া!
প্রসঙ্গত, বুকার পুরষ্কারপ্রাপ্ত অরুন্ধতী রায়, তার প্রথম ফিকশন ‘দ্য গড অব স্মল থিংস’ লেখার দুই দশক পর লিখেছেন উপন্যাস ‘দ্য মিনিস্ট্রি অব আটমোস্ট হ্যাপিনেস’। এটি সারা দুনিয়ায় সাড়া ফেলেছে, আগ্রহ তৈরি করেছে অগুণিত পাঠকের মধ্যে। তাই এই বইটি নিয়ে ‘পাঠশালা’র আয়োজনেও অভিনব সাড়া মিলেছে টরন্টোর সাহিত্যামোদীদের কাছ থেকে। অতি জটিল পথে আবর্তিত গল্পটিকে সেরীন খুব মুন্সিয়ানায় বোধগম্যের ভেতর নিয়ে এসেছেন।
সেরীন ফেরদৌসের সাচ্ছন্দ ও সাবলীল উপস্থাপনায়, পাঠশালায় অংশগ্রহণকারীরাও অবলীলায় ভ্রমণ করেছেন পুরোনো দিল্লী, পুরোনো দিল্লীর গোরস্তান থেকে নয়া দিল্লীর জীবনযাত্রায়, আবার সেখান থেকে কাশ্মীরের উপত্যকায়, পর্বতে – যেখানে যুদ্ধই শান্তি কিংবা শান্তিই যুদ্ধ।
আলোচনার পর এক প্রাণবন্ত প্রশ্ন-উত্তর পর্বে আগত সাহিত্যানুরাগীদের সাথে মিলিত হন সেরীন ফেরদৌস।