সরকারি মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে চালু হচ্ছে ওয়ান স্টপ ইমার্জেন্সি সার্ভিস

390

সরকারি মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ওয়ান স্টপ ইমার্জেন্সি সার্ভিস চালুর উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। দেশের চিকিত্সা সেবার মান আন্তর্জাতিক মানদণ্ডে উন্নীত এবং যুগোপযোগী করতেই এই উদ্যোগ। পর্যায়ক্রমে জেলা ও উপজেলা পর্যায়ের হাসপাতালেও ওয়ান স্টপ ইমার্জেন্সি সার্ভিস চালু করা হবে। আর এটা চালু হওয়ার মাধ্যমে হাসপাতালে পূর্ণাঙ্গ জরুরি সেবা পাওয়া যাবে।

আধুনিক যুগেও সরকারি হাসপাতালগুলোতে পূর্ণাঙ্গ জরুরি বিভাগ এখনো গড়ে ওঠেনি। এ কারণে চিকিত্সা নিতে আসা অনেক জরুরি রোগীদের দিগ্বিদিক ছোটাছুটি করতে হয়। রোগীকে একই হাসপাতালের আরেক বিভাগ এমনকি অন্য হাসপাতালেও প্রেরণ করা হয়ে থাকে। ওয়ান স্টপ ইমার্জেন্সি সার্ভিস চালু না থাকায় রোগীকে হাসপাতালের ইনডোরে সংশ্লিষ্ট বিভাগে বিশেষজ্ঞদের মতামতের জন্য, রোগ নির্ণয়ে জরুরি পরীক্ষা-নিরীক্ষা কিংবা অন্য হাসপাতালে প্রেরণ করতে হয়।

তাত্ক্ষণিক কিংবা সময়মতো চিকিত্সা না পাওয়ায় ট্রলিতে কিংবা রাস্তায় ২০ থেকে ২৫ ভাগ জরুরি রোগীর মৃত্যু হয় বলে জরুরি বিভাগের চিকিত্সকরা অভিমত ব্যক্ত করেছেন। স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম জানান, সরকারি মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালগুলোতে দ্রুতই ওয়ান স্টপ ইমার্জেন্সি সার্ভিস চালু করা হবে। জানা গেছে, ওয়ান স্টপ ইমার্জেন্সি সার্ভিস চালু করতে সহযোগিতা করছে আন্তর্জাতিক সংস্থা রেড ক্রিসেন্ট।

হাসপাতালের জরুরি বিভাগে ওয়ান স্টপ ইমার্জেন্সি সার্ভিসে থাকবে ইসিজি, এক্সরে, প্যাথলজির সুবিধাসহ বিশেষজ্ঞ চিকিত্সক টিম। মেডিসিন, সার্জারি, গাইনিসহ স্ব স্ব বিভাগের বিশেষজ্ঞ চিকিত্সকদের সমন্বয়ে মেডিক্যাল টিম সার্বক্ষণিক থাকবে। এছাড়া পাশেই থাকবে অপারেশন থিয়েটার এবং অক্সিজেন সুযোগ-সুবিধাসহ অবজারভেশন ওয়ার্ড যাতে যে কোনো জরুরি চিকিত্সা তাত্ক্ষণিক প্রদান করা যায়। এছাড়া সংযুক্ত থাকবে অ্যাম্বুলেন্স। একটা কল নম্বরে ফোন দিলেই সংশ্লিস্ট জায়গায় চলে যাবে অ্যাম্বুলেন্স।

কিন্তু এদেশে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল ছাড়া অন্য কোনো সরকারি মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের জরুরি বিভাগের চিত্র সম্পূর্ণ ভিন্ন। জরুরি সেবার বিন্দুমাত্র চিত্র সেখানে নেই। জরুরি বিভাগে থাকেন মেডিক্যাল অফিসার। তারা রোগী আসামাত্রই সংশ্লিষ্ট বিভাগে পাঠিয়ে দেন। এছাড়া অন্য হাসপাতালেও পাঠিয়ে থাকেন তারা।

অধিকাংশ হাসপাতালে শুধু নামেই জরুরি বিভাগ। জীবনের ঝুঁকিতে থাকা এসব রোগীকে চিকিত্সার জন্য পাঠানো হয় হাসপাতালের ইনডোরে সংশ্লিষ্ট ওয়ার্ডে বিশেষজ্ঞের মতামতের জন্য। গত ১ জুলাই দুপুরে প্রায় এক ঘণ্টা স্যার সলিমুল্লাহ মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের জরুরি বিভাগে অবস্থান করে দেখা যায়, ব্রেনস্ট্রোকে আক্রান্ত রফিক আহমেদকে (৭৫) চিকিত্সার জন্য নিয়ে এসেছেন তার স্বজন সীমা আক্তার। ইমার্জেন্সি টিকিট কাউন্টারে তখন প্রচণ্ড ভিড়। তাই অনেকক্ষণ লাইনে দাঁড়িয়ে বিউটি ১০ টাকার একটি টিকিট সংগ্রহ করেন।

এর পর তিনি রোগী ও টিকিট নিয়ে ছুটে যান ইমার্জেন্সি মেডিক্যাল অফিসারের কক্ষে। সেখানে মেডিক্যাল অফিসার টিকিটের ওপর ‘ভর্তি’ লিখে কাজ সারেন। এর পর বিউটি টিকিট নিয়ে আবার যান ইমার্জেন্সি টিকিট কাউন্টারে। কাউন্টারের লোকজন সোনা মিয়ার নামে একটি ভর্তি ফাইল তৈরি করে পাঠিয়ে দেন হাসপাতালের ইনডোরে মেডিসিন ওয়ার্ডে। অগত্যা মেডিসিন ওয়ার্ডের উদ্দেশে সোনা মিয়াকে নিয়ে ছোটেন বিউটি। এর কিছুক্ষণ পর প্রসবব্যথা ওঠায় কুমু আক্তারকে (১৮) নিয়ে ইমার্জেন্সি টিকিট কাউন্টারে আসেন তার স্বজন রিয়া আক্তার। তিনিও অনেক ভোগান্তি সয়ে সংগ্রহ করেন টিকিট। রোগী নিয়ে ছুটে যান ইমার্জেন্সি মেডিক্যাল অফিসারের কক্ষে। মেডিক্যাল অফিসার রিয়াকে চিকিৎসার জন্য রেফার করেন হাসপাতালের গাইনি ওয়ার্ডে।

সরেজমিন দেখা যায়, শুধু এই দুই রোগী নয়, কাউকেই চিকিত্সা দেওয়া হয়নি জরুরি বিভাগে। বিশেষজ্ঞ চিকিত্সকরা বলেন, দেশে প্রতিদিন যত সংকটাপন্ন রোগী হাসপাতালে আসার কিছু সময়ের মধ্যে মারা যান, এর বড় অংশকেই হয়তো বাঁচানো সম্ভব হতো দেশের হাসপাতালগুলোতে ওয়ান স্টপ ইমার্জেন্সি চিকিত্সা সেবা চালু থাকলে।

বিশেষজ্ঞ চিকিত্সকরা বলেন, দেশের হাসপাতালগুলোতে জরুরি বিভাগে যে ক্যাটাগরির চিকিত্সকরা দায়িত্ব পালন করেন তারা জটিল রোগীদের চিকিত্সা দিতে পারবেন না। কারণ সেখানে কোনো বিশেষজ্ঞ চিকিত্সক দায়িত্ব পালন করেন না। তাই যারা থাকেন রোগীকে ওয়ার্ডে পাঠিয়ে দেওয়া ছাড়া তাদের কোনো গতি থাকে না। তবে রোগীকে আগে কোন ওয়ার্ডে পাঠানো উচিত, তা নির্বাচিত করা নিয়েও সমস্যা থেকে যায়।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের প্রতিবেদন অনুযায়ী, বাংলাদেশে মোট ৬০৩টি সরকারি হাসপাতাল আছে। প্রতিটি হাসপাতালেই রয়েছে নামসর্বস্ব জরুরি বিভাগ। তবে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের জরুরি বিভাগ অনেকটা আধুনিকতার ছোঁয়া পেয়েছে। এই হাসপাতাল দেশের একটি স্বনামধন্য সর্ববৃহত্ চিকিৎসা সেবা প্রতিষ্ঠান। এই হাসপাতালের চিকিৎসা সেবার মান সুবিদিত এবং সর্বমহলে প্রশংসিত। এখানে ২৪ ঘণ্টা জরুরি ও আন্তঃবিভাগে সেবা প্রদান করা হচ্ছে। চিকিৎসা সেবার জন্য আগত কোন রোগীকেই ফেরত প্রদান করা হয় না।

দেশের আপামর জনগণের সুচিকিত্সার জন্য প্রতিষ্ঠানটি আস্থা ও বিশ্বাসের প্রতীক হয়ে দাঁড়িয়েছে। এ হাসপাতালের ইনডোর, আউটডোর ও জরুরি অপারেশনসহ প্রতিদিন ১০ সহস্রাধিক রোগীর চিকিত্সা প্রদান করা হয়ে থাকে। হাসপাতালে প্রতিদিন রোগী, দর্শনার্থীসহ ২৫/৩০ হাজার লোকের সমাগম ঘটে। এই ক্রমবর্ধমান রোগীর সংখ্যা ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের চিকিত্সা সেবার প্রতি সর্ব সাধারণের আস্থা ও নির্ভরতার এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত।

রোগীর চাহিদার কথা বিবেচনায় নিয়ে শয্যা সংখ্যা কয়েক গুণ বৃদ্ধি করা হলেও জনবল ও অন্যান্য প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতির সংখ্যা এখনো অনেক অপ্রতুল। প্রয়োজনের তুলনায় অত্যন্ত সীমিত জনবল দিয়ে সুষ্ঠুভাবে প্রশাসন পরিচালনা ও রোগীদের কাঙ্ক্ষিত সেবা প্রদান করা হয়। সকল চিকিত্সক, নার্স, কর্মকর্তা-কর্মচারীদের আন্তরিক প্রচেষ্টায় সীমিত জনবল দিয়েই ২৬শ শয্যার হাসপাতালটিতে প্রতিদিন রোগী চিকিত্সাধীন থাকে ৩৬০০/৩৭০০ জন। প্রতিদিন ৫ হাজার থেকে ৬ হাজার রোগীকে বহিঃবিভাগের চিকিৎসা সেবা দেওয়া হয়। আড়াইশ থেকে ৩শ রোগীর জরুরি ও নিয়মিত অস্ত্রোপচার সম্পন্ন করা হয়। বর্তমানে তিনটি বিভাগে রুটিন অস্ত্রোপচারসমূহ দুই শিফটে করা হচ্ছে।

অর্থাৎ সকাল থেকে বিরতিহীনভাবে রাত ৮টা পর্যন্ত রুটিন অপারেশন করা হয়। এখানে আগত সকল গরিব রোগীর প্রয়োজনীয় ওষুধ ও পথ্য বিনামূল্যে সরবরাহ করা হয়। সবচেয়ে বড় কথা, এই হাসপাতালে পূর্ণাঙ্গ জরুরি বিভাগ গড়ে উঠেছে। যে কোন জরুরি রোগী এখানে প্রাথমিক চিকিৎসা নিতে পারেন।

ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল একেএম নাসির উদ্দিন জানান, ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ইমার্জেন্সি বিভাগে অনেক সুযোগ-সুবিধা আছে। এখন এক্সরে ও ২৪ ঘণ্টা প্যাথলজি সেবা চালু আছে। শিগগিরই ইমার্জেন্সিতে সিটি স্ক্যান ও ইসিজি সংযুক্ত করা হবে।

নির্যাতনের হাত থেকে রক্ষা পেতে ও প্রাণে বাঁচতে মিয়ানমার থেকে রোহিঙ্গারা বাংলাদেশে আসার পর আন্তর্জাতিক সংস্থা রেড ক্রিসেন্ট’র প্রতিনিধিরা এদেশে আসেন। সেসময় তাদের কাছে হাসপাতালে ওয়ান স্টপ ইমার্জেন্সি সার্ভিস চালু করার আগ্রহ প্রকাশ করেন স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. আবুল কালাম। রেড ক্রিসেন্টের পক্ষ থেকে সার্বিক সহযোগিতার আশ্বাস দেওয়া হয়। শুরু হয়ে যায় ওয়ান স্টপ ইমার্জেন্সি সার্ভিস চালু করার কার্যক্রম।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. আবুল কালাম আজাদ জানান, ওয়ান স্টপ ইমার্জেন্সি সার্ভিস চালু করতে রেড ক্রিসেন্ট’র সঙ্গে আলোচনা চলছে। তারা সহযোগিতা প্রদান করবে। আর এ সেবা চালু হলে চিকিত্সা সেবায় বড় পরিবর্তন আসবে। ইতোমধ্যে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ওয়ান স্টপ ইমার্জেন্সি সার্ভিস চালু করার কার্যক্রম শুরু করেছে।

Leave A Reply

Your email address will not be published.