বিক্ষোভরত ছাত্র-ছাত্রীদের ঘরে ফিরে যাওয়ার আহ্বান প্রধানমন্ত্রীর
ঢাকা : তৃতীয় পক্ষের অনুপ্রবেশ ঘটায় আন্দোলনকারীদের নিরাপত্তার শংকায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আজ নিরাপদ সড়কের দাবিতে আন্দোলনরত কোমলমতি ছাত্র-ছাত্রীদের ঘরে ফিরে যাওয়ার আহবান জানিয়েছেন।গত ২৯ জুলাই রাজধানীর কুর্মিটোলায় শহীদ রমিজউদ্দিন স্কুল এন্ড কলেজের দু’শিক্ষার্থী বাসচাপায় নিহত হবার প্রতিবাদে বিগত এক সপ্তাহ যাবত নিরাপদ সড়ক প্রতিষ্ঠাসহ বিভিন্ন দাবিতে স্কুলের শিক্ষার্থীরা রাজপথে আন্দোলন চালিয়ে আসছে।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘আমি এখন শংকিত এই স্কুলের ছাত্র-ছাত্রীকে নিয়ে। কারণ, অতীতে যারা আগুন দিয়ে পুড়িয়ে মানুষ হত্যা করতে পারে, শিক্ষার্থীদের হত্যা করতে পারে, চলন্ত গাড়িতে পেট্রল ছুঁড়ে মেরে মানুষ হত্যা করতে পারে তারা যখন এর সঙ্গে নেমে আসে তখন তারা কি না করতে পারে।’প্রধানমন্ত্রী এ সময় বলেন, তাঁর কাছে তথ্য রয়েছে গাউসিয়া মার্কেটে স্কুল পোষাক তৈরীর হার অনেক বেড়ে গেছে, পলাশিতে স্কুলের শিক্ষার্থীদের নতুন পরিচয়পত্র তৈরী করা হচ্ছে, মুখে কাপড় বেঁধে, হেলমেট পরে এরা হামলায় অংশ নিচ্ছে। যা শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তার জন্য বিরাট হুমকি।
প্রধানমন্ত্রী আজ গণভবন থেকে ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে বাংলাদেশ কম্পিউটার কাউন্সিল বাস্তবায়নাধীন ‘জাতীয় তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি অবকাঠামো উন্নয়ন’ শীর্ষক প্রকল্পের অধীনে ১০টি জেলার ৩শ টি ইউনিয়নের অপটিক্যাল ফাইবার কানেকটিভিটির উদ্বোধনকালে একথা বলেন।প্রধানমন্ত্রী প্রযুক্তিকে মানুষের কল্যাণে এবং গঠনমুলক কাজে ব্যবহারের আহবান জানিয়ে কোন গুজবে বা মিথ্যা প্রচারে বিভ্রান্ত না হবার আহবান জানান।
তিনি বলেন, আজকে এই ডিজিটাল পদ্ধতিতে মানুষের যেমন সেবা বাড়ছে তেমনি মাঝে মাঝে কিছু ঝামেলারও সৃষ্টি হচ্ছে। আমরা যেখানে আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করছি সেখানে সোশ্যাল মিডিয়াতে অপপ্রচার চালিয়ে দেশের ভেতর একটি অশান্ত পরিবেশ সৃষ্টিরও কেউ কেউ চেষ্টা চালাচ্ছে।তিনি বলেন, ‘কেউ গুজবে কান দেবেন না, মিথ্যা অপপ্রচারে কেউ বিভ্রান্ত হবেন না। সেটাই আমি সকলকে বলব, যাই দেখেন শোনেন আগে যাচাই করে নেবেন। যাচাই না করে যেন কোন কিছু করবেন না। বিশেষ করে স্কুলের ছাত্র-ছাত্রী- যুব সমাজের প্রতি আমার এই আহবান থাকবে।’
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ইন্টারনেট সোশ্যাল মিডিয়া, ফেসবুক-ইউটিব-এগুলো ভালো কাজে ব্যবহার করুন, গুজন বা বিভ্রান্তি ছড়ানোর কাজে নয়। ‘সেখানে নোংরা বক্তব্য দেয়া, নোংরা কথা বলা, অপপ্রচার চালানো পরিহার করতে হবে,’ – যোগ করেন প্রধানমন্ত্রী। শেখ হাসিনা বলেন, ‘আধুনিক প্রযুক্তি যেটা মানুষের জীবন গড়ার কাজে, জীবনকে সুন্দর করার কাজে ব্যবহার করতে পারি। শিক্ষা গ্রহণের কাজে ব্যবহার করতে পারি সেটার যেন কোনভাবেই অপব্যবহার না ঘটে সেটাই আমরা চাই।’
আন্দোলনকারীদের সরকারের পক্ষ থেকে কোন বাধা দেয়া হয়নি উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘আমাদের ছেলে-মেয়েরা রাস্তায় নেমেছে তাদেরকে আমরা কোন বাধাই দেইনি। যাই করুক আমি বলেছি যে, ধৈর্য ধরতে হবে, দেখতে হবে।’
প্রধানমন্ত্রী বলেন, মন্ত্রী-এমপিদের গাড়ি থামিয়ে তাদের হেঁটে চলে যেতে বলেছে, গাড়িতে আগুন দিয়েছে। পুলিশের মোটরসাইকেল আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দিয়েছে। আমি সবাইকে ধৈর্য ধরতে বলেছি। শিক্ষার্থীদের ওপর যেন কোনো আঘাত করা না হয় সে নির্দেশনা দিয়েছি।
বাস চাপায় শহীদ রমিজউদ্দিন স্কুল এন্ড কলেজের দুই শিক্ষার্থীর মৃত্যু প্রসঙ্গে প্রধানমন্ত্রী বলেন, এই ঘটনায় দায়ীদের ইতোমধ্যে গ্রেফতার করা হয়েছে এবং বিচার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে।রাস্তায় চলাচলে ট্রাফিক আইন মেনে চলার আহবান জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, স্কুল থেকেই শিশুদের ট্রাফিক আইন শেখাতে হবে।স্কুল থেকে ট্রাফিক আইন শেখাতে সরকারের উদ্যোগের কথা তুলে ধরে প্রধানমন্ত্রী বলেন, স্কুল থেকে ট্রাফিক আইন শিক্ষার জন্য ইতোমধ্যে শিক্ষা মন্ত্রণালয়কে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
তিনি বলেন, অনেক কিছু আমরা আগেই করেছি। এরপরও ওভার ব্রিজ, আন্ডার পাস করছি। রাস্তা পারাপারে ওভারব্রিজ ব্যবহার করতে হবে। কেউ ওভারব্রিজ রেখে রাস্তা দিয়ে হেঁটে পার হলে যদি কোনও দুর্ঘটনা ঘটে তার দায় নেবে কে?
প্রধানমন্ত্রী বলেন, কিছু বিষয় আছে যেগুলো একদিনে হয় না। যেগুলো বাস্তবায়ন হতে তো একটু সময় লাগবে। তবে আমরা চেষ্টা করে যাচ্ছি। আন্দোলন ছেড়ে ছাত্র-ছাত্রীদের ক্লাসে ফিরে যাওয়ার আহবান জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, তাঁদের দাবিগুলো সরকার মেনে নিয়েছে এবং সেগুলো বাস্তবায়নও শুরু করেছে। তিনি বলেন, একটা শ্রেনীই রয়েছে যাদের কাজ ঘোলা পানিতে মাছ শিকার করা। যারা চেষ্টা করে যাচ্ছে যে, এমন একটা পরিস্থিতিতে তারা কোন অবস্থান তৈরী করতে পারে কি না।
প্রধানমন্ত্রী উদাহারণ দিয়ে বলেন, গতকাল গুজব ছড়ানো হলো, আওয়ামী লীগ অফিসে নাকি মেরে চারজনের লাশ রেখে দেওয়া হয়েছে। মেয়েদের ধরে নিয়ে নির্যাতন করা হয়েছে। এই গুজবের পর ছাত্রলীগ সেক্রেটারি ২০/২৫ জন শিক্ষার্থীকে অফিসে নিয়ে আসে। সেখানে তারা (শিক্ষার্থীরা) তন্ন তন্ন করে সব কিছু খুঁজে দেখেছে। কই তারা কোথাও তো কিছুই পায়নি।
তিনি বলেন, তাহলে আওয়ামী লীগ অফিসে আক্রমণটা কারা করলো এবং আমাদের প্রায় ১৭/১৮ জন কর্মী সেখানে আহত হয় এবং যাদের অনেকে হাসপাতালে। আমার কাছে বার বার খবর আসছে যে, সমানে ঢিল ছোঁড়া হচ্ছে।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, স্কুলের ব্যাগের ভেতরে পাথর, ছাত্রদের ব্যাগেতো বই থাকবে। তাদের ব্যাগে পাথর থাকবে কেন? আর সেই পাথর আওয়ামী লীগ অফিসে তারা ছুঁড়ে মেরেছে এবং জানালা- দরজার কাঁচ ভেঙ্গে একাকার করেছে। প্রধানমন্ত্রী তখনও দলের নেতা-কর্মীদের ধৈর্য ধরার আহবান জানান উল্লেখ করে বলেন, ‘আহত হলেও ধৈর্য ধরো, দেখো কতদূর করতে পারে।’ তিনি বলেন, ‘একটা ঘটনা দেখে আপনারা বুঝতে পারেন। বিডিআর গেটে হামলা, সেখানে ব্লাংক ফায়ার হচ্ছে, এই অস্ত্রটা কোত্থেকে আসল, কারা গুলি করল?’
তিনি বলেন, অপপ্রচার চালিয়ে দেশের মধ্যে একটা অশান্ত পরিবেশ সৃষ্টি করা, আর যারা এইগুলো করতে পারে তারা এই কোমলমতি শিশুদের যে কোন আঘাত করবে না বা তাদের কোন ক্ষতি করবে না, এটা কে বলতে পারে। এখন যখন এই তৃতীয় পক্ষ নেমেছে যেকোন একটা অঘটন যদি ঘটায়, তাহলে তার দায় দায়িত্ব কে নেবে। শেখ হাসিনা বলেন, কাজেই যেকোন একটা ভয়াবহ অবস্থা তারা করতে পারে। সেজন্য আমি সমস্ত অভিভাবক, পিতা-মাতা-তাঁদেরকে আমি অনুরোধ করবো যে আপনারা আপনাদের শিশুদেরকে ঘরে রাখেন। আপনাদের ছেলে-মেয়েকে ঘরে রাখেন।
তিনি সন্তানদের নিরাপত্তার কথা ভেবে অভিভাবকদের সতর্ক হওয়ার আহবান জানিয়ে শিক্ষকদের উদ্দেশ্যে বলেন, ‘প্রতিটি স্কুলের শিক্ষক, প্রধান শিক্ষকসহ কলেজের অধ্যক্ষ থেকে শুরু করে বিশ্ববিদ্যালয়-সকলকে আমি অনুরোধ করবো। আপনারা আপনাদের শিক্ষার্থীদের ক্লাশে ফিরিয়ে নেন।’তিনি বলেন, ‘আর কোনো বাবা-মায়ের কোল খালি হোক আমি চাই না। কারণ, হারানোর বেদনা আমি বুঝি।’প্রধানমন্ত্রী এ সময় তথাকথিত কিছু সংবাদ পত্র- মিডিয়া যারা দেশের ভাল দেখতে চায় না তারা সময় সময় বিভিন্ন গুজবকে উস্কে দিয়ে দেশে গোলযোগ বাধানোর ষড়যন্ত্রে লিপ্ত বলেও অভিযোগ করেন।
প্রধানমন্ত্রী তাঁর ভাষণে দেশে তাঁর সরকারের সময়ে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি সম্প্রসারণের বিভিন্ন চিত্রও তুলে ধরেন।
তিনি বলেন, অতীতে বিএনপি সরকার বিনামূল্যে সাবমেরিন কেবলের সঙ্গে সংযুক্ত হবার সুযোগ হাতছাড়া করেছিল, দেশের তথ্য পাচার হয়ে যাবার অজুহাত তুলে। তারপর অনেক কষ্ট করে, অনেক অর্থ ব্যয় করে এসব করতে হয়েছে তাঁর সরকারকে।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমরা যখন ’৯৬ সালে সরকার গঠন করলাম তখন এই অঞ্চলের সবদেশে কানেকটিভিটি (ফাইবার অপটিক) হয়ে গেছে। সেজন্য এককভাবে সিঙ্গাপুর থেকে সমুদ্রের তলদেশ দিয়ে বাংলাদেশকে এই সংযোগ আনতে হয়। ২০০৯ সালে ক্ষমতায় আসার পর তাঁর সরকার দ্বিতীয় সাবমেরিন কেবলের সংযোগ দেশে এনেছে। প্রধানমন্ত্রী কল্যাণমূলক কাজে প্রযুক্তি ব্যবহারে ছোটদের উদ্বুদ্ধ করার জন্যও এ সময় অভিভাবকদের প্রতি আহবান জানান।