আটলান্টিক সিটিতে ‘বাংলাদেশ মেলা’ যেন একখণ্ড বাংলাদেশ
আটলান্টিক সিটি থেকে সুব্রত চৌধুরি- : বঙ্গোপসাগরের বুক চিরে জেগে ওঠা নতুন ভূখণ্ডের মতো বাংলাদেশ থেকে হাজার হাজার মাইল দূরে যুক্তরাষ্ট্রের নিউজারসি অঙ্গরাজ্যের আটলানটিক মহাসাগর বিধৌত আটলান্টিক সিটির বুকে গত পহেলা অাগস্ট,বুধবার যেন জেগে উঠেছিল একখণ্ড বাংলাদেশ। বাংলাদেশ এসোসিয়েশন অব অ্যাটলান্টিক কাউনটির উদ্যোগে সেন্ড ক্যাসল স্টেডিয়াম এর সুবিশাল প্রান্তরে অনুষ্ঠিত হলো “বাংলাদেশ মেলা – ২০১৮” ।বিকেল গড়াতেই নিউজারসির বিভিন্ন শহরে বসবাসকারী প্রবাসী বাংলাদেশীদের সব পথ এসে যেন মিশেছিল সেন্ড ক্যাসল ষ্টেডিয়াম এর খোলা প্রান্তরে।
পার্শ্ববর্তী অন্যান্য রাজ্য থেকেও প্রবাসী বাংলাদেশীদের সরব উপস্থিতি ছিল। সময় গড়াতেই প্রবাসী বাংলাদেশীদের কাদা থিক থিক ভিড়ে এই মেলা পরিনত হয় জনারণ্যে। মেলার হরেক আয়োজনের মধ্যে ছিল দেশীয় পন্যের বিকিকিনি, দেশীয় খাবারের স্টল,কৃতী ছাএ-ছাএী সম্বর্ধনা,গুণীজন সম্বর্ধনা, র্যাফেল ড্র,সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান।
“বাংলাদেশ মেলা”য় প্রধান অতিথি হিসাবে উপস্থিত ছিলেন আবদুল কাদের মিয়া ফাউন্ডেশন এর চেয়ারম্যান জনাব আবদুল কাদের মিয়া। আমন্ত্রিত অতিথি হিসাবে উপস্থিত ছিলেন আটলান্টিক সিটির মেয়র ফ্রাঙ্ক এম গিলিয়াম , নিউজারসি স্টেট সিনেটর ভ্যান ড্রিউ, স্টেট সিনেটর ক্রিস ব্রাউন, এসেম্বলি ম্যান জন আরমাটো , আটলান্টিক কাউনটি শেরিফ এরিক শেফলার, আটলান্টিক কাউনটির প্রধান নির্বাহী ডেনিস লেভিনসন, আটলান্টিক কাউনটির প্রসিকিউটর ডেমন জি টাইনার, আটলান্টিক সিটির কাউন্সিলরবৃন্দ । আয়োজক সংগঠনের সাধারন সম্পাদক সোহেল আহমদ অতিথিদেরকে বাংলাদেশ মেলায় উপস্থিত প্রবাসীদের সাথে পরিচয় করিয়ে দেন। বিকেল থেকেই প্রবাসী বাংলাদেশীরা মেলায় সমবেত হতে থাকে।বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্রে বেড়ে ওঠা বাংলাদেশী আমেরিকান শিশু- কিশোরদের অংশগ্রহন ছিল উল্লেখযোগ্য, বাংলাদেশের জাতীয় পতাকা হাতে, কপালে জাতীয় পতাকার ব্যান্ড বেঁধে, জাতীয় পতাকার রংয়ের পোশাক পরে তারা মেলায় যোগ দেয়।তাদের উৎসাহ, উচ্ছ্বাস ছিল চোখে পড়ার মতো। সারাক্ষণ নেচে-গেয়ে তারা মেলা প্রান্তরকে মুখরিত করে রাখে।
বিপুল সংখ্যক প্রবাসীর উপস্থিতিতে বিকেল সাড়ে ছয়টায় প্রধান অতিথি জনাব আবদুল কাদের মিয়া বেলুন উড়িয়ে ‘বাংলাদেশ মেলা’র শুভ উদ্বোধন করেন। এই পর্বে বক্তব্য রাখেন জনাব আবদুল কাদের মিয়া , শহীদ খান, মোঃ সেলিম, সৈয়দ মোঃ কাউছার, কাঞ্চণ বল ,সেলিম সুলতান , সোহেল আহমদ , ফরহাদ সিদ্দিক , মিরাজ খান।
এসময় বাংলাদেশ এসোসিয়েশন অব আটলান্টিক কাউনটির ট্রাষ্টি বোর্ডের প্রধান কাঞ্চণ বল, ট্রাষ্টি বোর্ডের সদস্য সাব্বির হোসেন ভূঁইয়া, সেলিম সুলতান, শামসুল ইসলাম শাহজাহান,মনির হোসেন, আবদুল জামিল,জাহাঙ্গীর হোসেন ভূঁইয়া, জসিম উদদীন, আয়োজক সংগঠনের সভাপতি শহীদ খান, সাধারন সম্পাদক সোহেল আহমদ,সংগঠনের প্রধান উপদেষ্টা সৈয়দ মোঃ কাউছার, “বাংলাদেশ মেলা – ২০১৮” এর আহবায়ক মোঃ সেলিম, সদস্য সচিব ফরহাদ সিদ্দিক, প্রধান পৃষ্ঠপোষক মিরাজ খান,সার্বিক তত্ত্বাবধানের প্রধান মাসুদ চৌধুরী, প্রধান সমন্বয়কারী বিপ্লব দাশ, সার্বিক সহযোগীতায় প্রধান গোলাম হাফিজ সহ বাংলাদেশ এসোসিয়েশন অব আটলান্টিক কাউনটির অন্যান্য নেতৃবৃন্দ উপস্থিত ছিলেন।]
বাংলাদেশ মেলায় বিভিন্ন পর্যায়ে বক্তব্য রাখেন প্রধান অতিথি সহ অন্যান্য অতিথিবৃন্দ। মেলার শুভ উদ্বোধন শেষে বাংলাদেশ ও যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় সংগীত পরিবেশনের পর প্রবাসে বেড়ে ওঠা শিশু,কিশোর-কিশোরীদের পরিবেশনায় পরিবেশিত হয় মনোজ্ঞ সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। সংগীত শিল্পী সান্ত্বনা রায় চৌধুরীর পরিচালনায় ও কোরিওগ্রাফার নিবেদিতা ভট্টাচার্যের নির্দেশনায় ছোটদের নান্দনিক পরিবেশনা মেলায় উপস্থিত প্রবাসীদের বিমোহিত করে। তাদের মনোমুগ্ধকর সংগীত ও নৃত্য পরিবেশনা দেখে উপস্থিত প্রবাসীদের চোখ ছানাবড়া হয়ে যায়,তাদের ভ্রম হয় এই শিশু-কিশোররা কী প্রবাসে বেড়ে ওঠা প্রজন্ম?এই র্পবটি সঞ্চালণা করেন জয়ন্ত সিংহ।
বাংলাদেশ মেলার অন্যতম আকর্ষণ ছিল প্রবাসী বাংলাদেশী আমেরিকান কৃতি ছাএ-ছাএীদেরকে সংবর্ধনা। এই মেলায় আটলান্টিক কাউনটির বিভিন্ন স্কুলের অষ্টম গ্রেড পর্যন্ত কৃতি ছাএ-ছাএীদেরকে ক্রেস্ট প্রদান করে সংবর্ধিত করা হয়।কৃতি ছাএ-ছাএীদের মাঝে ক্রেস্ট বিতরন করেন মেলায় আগত অতিথিবৃন্দ। এই সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে কৃতি ছাএ-ছাএীদের পক্ষে বক্তব্য রাখেন আটলান্টিক সিটি হাই স্কুল থেকে দ্বাদশ শ্রেণীর মেধা তালিকায় ষষ্ঠ স্থান অর্জনকারী কৃতি ছাএী মমতা মিলি,তাকে সহ দশম স্থান অর্জনকারী কৃতি ছাএী সালমা বেগমকেও ক্রেস্ট প্রদান করা হয় । বিপ্লব দেবের সঞ্চালণায় আয়োজক সংগঠনের এই কৃতি ছাএ-ছাএী সংবর্ধনা অনুষ্ঠানটি মেলায় উপস্থিত প্রবাসী বাংলাদেশীদের বেশ প্রশংসা কুড়োয়। বাংলাদেশ মেলার বিভিন্ন ষ্টলে দেশীয় পণ্য ও খাবারের স্টলগুলোতে বিকিকিনি ছিল লক্ষ্যণীয় । বাংলাদেশ মেলার অনুষ্ঠান সঞ্চালণা করেন প্রবাসের জনপ্রিয় সঞ্চালক আশরাফুল আলম বুলবুল,তাঁর সাবলীল উপস্থাপনা সবার প্রশংসা কুড়োয়।
আটলান্টিক সিটির তিন কৃতি প্রবাসী বাংলাদেশী আমেরিকানকে বাংলাদেশ মেলায় বিশেষ সম্মাননা দেওয়া হয়। তাঁরা হলেন কমিউনিটি সেবায় সাব্বির হোসেন ভূঁইয়া,সেলিম সুলতান ও সাংবাদিকতায় সুব্রত চৌধুরী।এছাড়া আটলান্টিক সিটি প্রেস ক্লাবকেও ক্রেস্ট প্রদান করা হয়। তাঁদের হাতে সম্মাননা স্মারক হিসাবে ক্রেস্ট তুলে দেন আয়োজক সংগঠনের নেতৃবৃন্দ ।
প্রধান অতিথি জনাব আবদুল কাদের মিয়াকে কমিউনিটি সেবায় অসামান্য অবদানের জন্য সন্মাননা স্মারক হিসাবে ক্রেস্ট প্রদান করা হয়। আটলান্টিক সিটির মেয়র ফ্রাঙ্ক এম গিলিয়াম , নিউজারসি স্টেট সিনেটর ভ্যান ড্রিউ ও মেলার সদস্য সচিব ফরহাদ সিদ্দিক আবদুল কাদের মিয়ার হাতে ক্রেস্ট তুলে দেন।
মেলার সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে সংগীত পরিবেশন করেন সংগীত শিল্পী সায়রা রেজা ও মারিয়া । তারা বিভিন্ন ধরনের সংগীত পরিবেশন করে দর্শকদের মাতিয়ে রাখেন। সবশেষে মঞ্চ মাতাতে আসেন বাংলাদেশের কিংবদন্তী সংগীত শিল্পী আবদুল হাদী । শিল্পী মঞ্চে এসে দাঁড়াতেই প্রবাসীরা উচ্ছ্বাসে ফেটে পড়েন।দর্শকদের অভিবাদন গ্রহন শেষে শিল্পীর একের পর এর সুরের মূর্ছনায় প্রবাসীরা অনাবিল আনন্দে মেতে ওঠেন। তাঁর গানের সাথে নেচে-গেয়ে প্রবাসীরা বেশ আনন্দ উপভোগ করেন। যন্ত্র সংগীতে শিল্পীদেরকে সহযোগীতা করেন মাটি ব্যান্ড এর সদস্যরা। সংগীত শিল্পী আবদুল হাদীকে আজীবন সন্মাননা হিসাবে ক্রেস্ট প্রদান করা হয়।
বাংলাদেশ মেলার টাইটেল স্পন্সর ছিল রেডিয়েণ্ট আইপি টিভি ও গ্র্যান্ড স্পন্সর উৎসব কুরিয়ার । বাংলাদেশ মেলায় গনমাধ্যম সহযোগী ছিল এনটিভি। র্যাফেল ড্রর মাধ্যমে বাংলাদেশ মেলার সমাপ্তি ঘটে।এতে বেশ কিছু আকর্ষণীয় পুরস্কারের সমাহার ছিল। এমনিতেই বাংলাদেশ এসোসিয়েশন অব আটলান্টিক কাউনটির সব কর্মকাণ্ডেই নান্দনিকতার ছোঁয়া মেলে, বাংলাদেশ মেলার বিশাল মহাযজ্ঞ সুষ্ঠুভাবে সম্পাদনের মাধ্যমে সংগঠকরা তাঁদের সাংগঠনিক দক্ষতার সর্বোচ্চ উৎকর্ষতার প্রমান দেন।যে কারনে তাঁরা উপস্থিত প্রবাসীদের বেশ বাহবা কুড়ান। বাংলাদেশ মেলার আহবায়ক মোঃ সেলিম সমাপনী বক্তব্য রাখেন।
অনতিদূরে্ গির্জার গ্র্যান্ড ফাদার ক্লকটা ঢং ঢং করে জানিয়ে দেয় রাত নিশুতির কথা।আইনগত বাধ্যবাধকতার কারনে অনিচ্ছা সত্ত্বেও মধ্যরাতের অনেক পরে বাংলাদেশ মেলার পর্দা নামে। এক সময় নিভে আসে মেলার আনন্দ আলো।প্রবাসীরা নিজ নিজ ডেরায় ফিরে যায় মুঠো মুঠো সুখস্মৃতি নিয়ে,আর সফল মেলা আয়োজনের জন্য আয়োজকদের টুপিখোলা অভিনন্দন জানিয়ে।