পল্লীবন্ধু হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ: এক দূরদর্শী রাষ্ট্রনায়ক

289

ঢাকা: সাবেক সফল রাষ্ট্রপতি ও জাতীয় পার্টির প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান পল্লীবন্ধু হুসেইন মুহম্মদ এরশাদকে ছাড়াই পার হলো একটি বছর। বাংলাদেশের উন্নয়নের কিংবদন্তী এরশাদ হয়তো স্বশরীরে নেই আমাদের মাঝে, কিন্তু তার অবদান ও উন্নয়নের স্মৃতি চিহ্ন অক্ষয় হয়ে আছে বাংলাদেশে। যতদিন বাংলাদেশ থাকবে, ততদিন পল্লীবন্ধুর কীর্তি অম্লান হয়ে থাকবে।

অসাধারণ এক বর্ণিল জীবনে অনেক কিছুই পেয়েছেন পল্লীবন্ধু। আবার, অনেক কিছুই করেছেন দেশ ও মানুষের জন্য। মানুষের প্রতি অকৃত্রিম ভালোবাসায় উপাধি পেয়েছেন পল্লীবন্ধু। এখনই প্রকৃত মূল্যায়ন হবে তার। ১৯৮৪ সালের ৪ আগস্ট জাতীর পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের মাজার জিয়ারত করেন তৎকালীন রাষ্ট্রপতি পল্লীবন্ধু হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ। বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি হিসেবে হুসেইন মুহম্মদ এরশাদই সর্ব প্রথম বঙ্গবন্ধুর মাজারে ফাতেহা পাঠ করে দোয়া মুনাজাত করেছিলেন। বাংলাদেশের রাজনীতিতে শ্রদ্ধা আর ভালোবাসার এক দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছিলেন তিনি।

১৯৩০ সালের ২০ মার্চ কুড়িগ্রাম শহরের “লাল দালান” বাড়ি খ্যাত নানাবাড়িতে জন্মগ্রহণ করেন পেয়ারা নামের যে শিশু। সেই শিশুই বড় হয়ে উন্নয়নের এক অনন্য ইতিহাস রচনা করেছেন বাংলাদেশে। শিশু পেয়ারা বড় হয়ে হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ নামে সাফল্যের সঙ্গে সেনাবাহিনী প্রধানের দায়িত্ব পালন করেছেন। রাষ্ট্র পরিচালনা করেছেন দীর্ঘ নয় বছর। প্রতিষ্ঠিত করেছেন জাতীয় পার্টির মত একটি রাজনৈতিক দল।

রাষ্ট্র ক্ষমতা ছেড়ে দেয়ার পর থেকে অংশ নেয়া প্রতিটি জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিজয়ী হয়েছেন হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ। জীবনে কোন নির্বাচনেই পরাজয়ের কালিমা স্পর্শ করতে পারেনি তাকে। পরপর দুই বার ১৯৯১ ও ১৯৯৬ সালের জাতীয় নির্বাচনে কারাগারে থেকে নির্বাচনে অংশ নিয়ে ৫টি করে আসনে জয়ী হয়ে বিশ্ব রেকর্ড সৃষ্টি করেছেন। একাদশ জাতীয় নির্বাচনের পর মন্ত্রীর পদমর্যাদায় প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ দূত এবং দ্বাদশ জাতীয় সংসদে বিরোধী দলীয় নেতা নির্বাচিত হয়েছিলেন।

২০১৯ সালের ১৪ জুলাই সকাল পৌনে ৮টায় ঢাকা সম্মিলিত সামরিক হাসপাতাল সিএমএইচে চির বিদায় নেন পল্লীবন্ধু হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ। ঢাকা সেনানিবাস, জাতীয় সংসদ ভবন, জাতীয় পার্টি কেন্দ্রীয় কার্যালয়, জাতীয় মসজিদ বায়তুল মোকাররম এবং রংপুরে কয়েক দফা জানাজা শেষে লাখো মানুষের ভালোবাসায় সিক্ত পল্লীবন্ধুকে রাষ্ট্রীয় ও সামরিক মর্যাদায় ১৬ জুলাই রংপুরের পল্লী নিবাসের লিচু বাগানে সমাহিত করা হয়।

গেলো বছর বাংলাদেশের বিরোধী দলীয় নেতার মর্যাদায় চির বিদায় জানানো হয়েছে তাকে। সৈনিক থেকে রাজনীতিতে উঠে আসা এক জীবনে এমন গৌরবগাঁথা নেই বললেই চলে। হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের অসংখ্য কীর্তির অল্প-স্বল্প উল্লেখ করা হলো।

উপজেলা পরিষদ সৃষ্টি

মৌলিক অধিকার ও রাষ্ট্রীয় সেবা তৃণমূল মানুষের দোড় গোড়ায় পৌঁছে দিতে ১৯৮২ সালের ৭ নভেম্বর থেকে ১৯৮৩ সালের ৭ নভেম্বরের মধ্যে ৪৬০টি উপজেলা পরিষদ সৃষ্টি করে ক্ষমতা বিকেন্দ্রীকরণ করেছেন হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ। পল্লী মানুষের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে ব্যাপক কর্মসূচি বাস্তবায়ন করেছেন উপজেলা পরিষদের মাধ্যমে।

শহরের সকল সেবা গ্রামীণ মানুষের কাছে পৌঁছে দিতে প্রতিটি উপজেলায় হাসপাতাল, মুন্সেফকোর্ট, পশু চিকিৎসা, কৃষি উন্নয়নসহ সকল সেবা নিশ্চিত করেছিলেন। প্রতিটি উপজেলায় শিক্ষা ও ক্রীড়া উন্নয়নে নানামুখী পদক্ষেপ নেন।

এ সময় ৪২টি মহকুমাকে জেলায় পরিণত করেন তিনি। এতে বাংলাদেশের জেলার সংখ্যা হয় ৬৪। মেগা প্রকল্পের মাধ্যমে উপজেলা ও জেলা সদর দপ্তর নির্মাণ করেন। ১৯৮৮ থেকে ৯০ সালে সারা দেশে ৫৬৮টি গুচ্ছগ্রাম স্থাপন করে ২১ হাজার ছিন্নমূল ভূমিহীন পরিবারকে পুনর্বাসিত করেন।

শিক্ষা ব্যবস্থার উন্নয়ন

জাতি গঠনের লক্ষ্যে শিক্ষা প্রসারে অসাধারণ কর্মকাণ্ড হাতে নিয়েছিলেন হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ। সার্বজনীন বাধ্যতামূলক প্রাথমিক শিক্ষা প্রবর্তনের পদক্ষেপ নেন। শিক্ষাকে বাস্তবমুখী, বিজ্ঞান ভিত্তিক এবং অর্থনৈতিক চাহিদার পূর্ণ উপযোগী হিসেবে ঢেলে সাজান।

প্রতি ২ কিলোমিটার এলাকা বা ২ হাজার মানুষের বসবাস এলাকায় একটি করে প্রাথমিক বিদ্যালয় নির্মাণের কাজ শুরু করেন। পঞ্চম শ্রেণী পর্যন্ত বিনামূল্যে পাঠ্য বই, খাতা ও পেন্সিল বিতরণ শুরুই করেন তিনি। চারটি শিক্ষা বোর্ডের পরীক্ষা একই দিনে নেয়া শুরু করেন। প্রতিটি উপজেলায় একটি বালক ও একটি বালিকা বিদ্যালয় এবং জেলা সদরে একটি কলেজকে আদর্শ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পরিণত করেন। ২১টি কলেজকে জাতীয়করণ করেন। ৯টি কলেজকে বিশ্ববিদ্যালয়ে উন্নীত করেন।

ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন। প্রাথমিক বিদ্যালয়, মাদ্রাসা ও কলেজ শিক্ষকদের আর্থিক সুবিধা ৭০ ভাগ বৃদ্ধি করেন। ৬টি বিশ্ববিদ্যালয় হল এবং ১৭টি কলেজ হোস্টেল নির্মাণ করেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে নিজের নামে কোন হোস্টেল নির্মাণ না করলেও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এবং জিয়াউর রহমানের নামে দুটি হোস্টেল নির্মাণ করেন হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য দোতলা বাসসহ অতিরিক্ত বাসের ব্যবস্থা করেন। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত রেল লাইন সম্প্রসারণ করেন। “পে অ্যাজ ইউ আর্ন” প্রকল্পে স্কুটার বরাদ্দ দিয়ে ছাত্রদের সম্পূরক আয়ের ব্যবস্থা করেন। কারিগরি শিক্ষা উন্নয়নে নানা কর্মসূচি নেন। প্রথম থেকে দ্বাদশ শ্রেণী পর্যন্ত ইংরেজি শিক্ষা বাধ্যতামূলক করেন। প্রাথমিক শিক্ষক নিয়োগে ৫০ ভাগ নারীদের জন্য সংরক্ষণ করেন। মেয়েদের জন্য পৃথক ক্যাডেট কলেজ প্রতিষ্ঠা করেন।

স্বাস্থ্য সেবার উন্নয়ন

উপজেলা পর্যায়ে ৩১ শয্যা বিশিষ্ট হাসপাতালে ৩ জন বিশেষজ্ঞসহ ৯ জন ডাক্তার নিয়োগ দিয়েছিলেন। পল্লী এলাকার ৩৯৭টি উপজেলার মধ্যে ৩৩৩টি স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স নির্মাণ করেন। সরকারি হাসপাতালগুলোতে পথ্যের জন্য বরাদ্দ ৮ হাজার থেকে বাড়িয়ে ১২ হাজার টাকা করেন। সারাদেশে ২৫ হাজার দাইকে প্রশিক্ষণের আওতায় আনেন। প্রতিটি ইউনিয়নে পরিবার কল্যাণ কেন্দ্র স্থাপন করে সেখানে ওষুধ ও কর্মচারী নিশ্চিত করেছিলেন। জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণে কার্যকর উদ্যোগ হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের আমলেই শুরু হয়েছিলো।

কৃষি উন্নয়ন

হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ বাজেটে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দেন কৃষিকে। সেচ প্রকল্পাধীন চাষাবাদ বাড়ানো হয়েছিলো দ্বিগুণ। সেচের জন্য ১৯৮৪ সালেই ১৭ হাজার ৩ শো গভীর নলকূপ, ১ লাখ ২৬ শত অগভীর নলকূপ, ৪২ হাজার শোলো-লিফট পাম্প বসান। মুহুরি এবং মেঘনা-ধনাগোদা সেচ প্রকল্প নির্মাণ কাজ শেষ করেন। সহজ শর্তে কৃষি ঋণ বিতরণ করেন। গমের উৎপাদন বৃদ্ধি করেন ৫ গুন বেশি। উল্লেখযোগ্য হারে কৃষিঋণ বাড়িয়ে দেন তিনি। অনাবাদী জমি চাষাবাদের আওতায় আনা হয়।

বিচার ব্যবস্থার উন্নয়ন

বিচার ব্যবস্থা সাধারণ মানুষের দোরগোড়ায় পৌঁছে দিতে রংপুর, যশোর, কুমিল্লা, বরিশাল, সিলেট এবং চট্টগ্রামে ৬টি হাই কোর্টের বেঞ্চ সম্প্রসারণ করেন। বিচার ব্যবস্থা দ্রুত করতে ১৮৯৮ সালের ফৌজদারি দণ্ডবিধি এবং ১৯০৮ সালের দেওয়ানী কার্যবিধি সংশোধন করেন। একই উদ্দেশ্যে প্রতিটি উপজেলায় মুন্সেফ কোর্ট স্থাপন করেন। যৌতুক নিরোধ আইন, নারী নির্যাতন প্রতিরোধ আইন, মুসলিম পারিবারিক আইন, বাল্যবিবাহ নিরোধ আইন জারি করেন। মামলার জট কমাতে উদ্যোগ নিয়েছিলেন পল্লীবন্ধু।

যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়ন

সড়ক পথে যোগাযোগ ব্যবস্থায় বৈপ্লবিক উন্নয়ন করেন হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ। ২ বছরে ২০৬টি উপজেলা সড়ক যোগাযোগের আওতায় আসে। ৮ হাজার কিলোমিটার পাকা সড়ক এবং ১৭ হাজার কিলোমিটারের বেশি কাঁচারাস্তা নির্মাণ করেন। ছোট-বড় ৫৮০টি সেতু নির্মাণ করেন। রাজধানীতে নর্থ সাউথ ও ওয়ারী খাল রোড নির্মাণ করেন। মিরপুর-আগারগাঁও রোড প্রকল্প শুরু করেন। পান্থপথ ও রোকেয়া স্মরণী সড়ক নির্মাণ করেন।

ফুলবাড়িয়া কেন্দ্রীয় বাস টার্মিনালের ভিড় কমাতে তেজগাঁও, গাবতলি ও যাত্রাবাড়ীতে তিনটি বাস টার্মিনাল নির্মাণ করেন। যানজট নিরসনে ট্রাফিক সিগন্যাল চালু করেন। ঢাকা বন্যা নিরোধ বাঁধ নির্মাণ করেন। এতে ঢাকা শহর বন্যার জলাবদ্ধতা থেকে রক্ষা পেয়েছে আবার রাজধানীর বাইরে দিয়ে একটি বিশাল সড়ক নির্মিত হয়েছে। যাতে রাজধানী শহরের যানজট অনেকটাই কমেছে।

ঢাকা-মাওয়া বিকল্প সড়ক দ্রুততার সাথে এগিয়ে নেন। ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের নিন্মাঞ্চলীয় রাস্তা নির্মাণ করেন। চীনের সহায়তায় বুড়িগঙ্গা নদীর ওপর সেতু নির্মাণ করেন। জাপানের সহায়তায় মেঘনা এবং মেঘনা-গোমতী সেতু নির্মাণের সম্ভাব্যতা চূড়ান্ত করেন। খুলনা-মংলা এবং কুমিল্লা-চান্দিনা বাইপাস সড়ক নির্মাণ করেন। সিলেট থেকে ভৈরব হয়ে ঢাকা সড়ক নির্মাণ করেন।

কাজের বিনিময়ে খাদ্য কর্মসূচির আওতায় গ্রামাঞ্চলের রাস্তা-ঘাটের ব্যাপক উন্নয়ন করেন। রেলওয়ে বোর্ড বিলুপ্ত করে রেলওয়ে পূর্বাঞ্চল এবং রেলওয়ে পশ্চিমাঞ্চল নামে দুটি সংস্থা গঠন করেন। রেলওয়ের ৩০টি ইঞ্জিন, ১২ শো ৫৫টি মালবাহী বগি সংগ্রহ করেন এবং ১০৬টি যাত্রীবাহী বগি সংগ্রহের উদ্যোগ নেন।

বেসরকারি বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষ নামে একটি প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলেন। রাজশাহী বিমান বন্দরের কাজ সমাপ্ত করেন। সিলেট ওসমানী বিমান বন্দর সম্প্রসারণ করেন। চট্টগ্রাম বিমান বন্দরে বোয়িং ওঠা-নামার জন্য রানওয়ে সম্প্রসারণ করেন। ৪টি আধুনিক ডিসি ১০-৩০ বিমান ক্রয় করেন। শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমান বন্দরের ভিআইপি টার্মিনাল নির্মাণ করেন। ২৮৭টি উপজেলায় হেলিপ্যাড নির্মাণ করেন।

২১২ কোটি টাকা ব্যয়ে ২১২টি উপজেলায় উন্নত ডাক ব্যবস্থা নিশ্চিত করেন। ১৯৮৩ সালের ডিসেম্বর থেকে বাংলাদেশ টেলিফোনে সরাসরি আন্তর্জাতিক ডায়ালিং করতে সমর্থ হয়। ১৯৮৩ সালে ৭৮টি উপজেলায় ৩০ লাইনের মেগনেটো এক্সচেঞ্জ স্থাপন করেন।

শিল্প ও অর্থনীতি

অধিকতর সুষ্ঠু ও ন্যায় সঙ্গত কর-কাঠামো প্রবর্তন করেছেন এরশাদ। স্টক এক্সচেঞ্জ পুনরুজ্জীবিত করেন। দেশের উপজেলা ও গ্রামাঞ্চলে স্বল্প সুদে গৃহ নির্মাণ ঋণ এর ব্যবস্থা করেন। বেসরকারি পর্যায়ে শিল্প স্থাপনে উৎসাহ দিতে ৩৩টি পাটকল থেকে পূঁজি প্রত্যাহার করে সেগুলো বাংলাদেশি মালিকদের কাছে প্রত্যর্পণ করেন। বিদ্যমান দু’টি কর্পোরেশনের পাশাপাশি জীবন ও সাধারণ বীমা ব্যবসা চালানোর অনুমতি দেন। চট্টগ্রামে রফতানি প্রক্রিয়াজাতকরণ জোনের কাজ শুরু করেন। নতুন শিল্পের মঞ্জুর দানে ওয়ান স্টপ সার্ভিস চালু করেন। ক্ষুদ্র, কুটির এবং হস্তচালিত তাঁত শিল্পের জন্য উৎসাহ প্রদান করেন। রাজধানীর কাঁচাবাজারগুলো ভেঙে আধুনিক ও বহুতল বিশিষ্ট ভবন তৈরি করেন।

ইটের ভাটায় কাঠের পরিবর্তে কয়লা ব্যবহারে উৎসাহ প্রদান করেন। কক্সবাজারকে আন্তর্জাতিক মানের পর্যটন কেন্দ্রে পরিণত করতে নানামুখী কর্মসূচি হাতে নেন। অবাধ ট্রেড ইউনিয়ন কার্যক্রম, যৌথ দল-কষাকষির এজেন্ট নির্ধারণ এবং টেড ইউনিয়নের নির্বাচনের অনুমতি দেন তিনি। অধিক হারে বিদেশে চাকরি প্রাপ্তির সুযোগ বৃদ্ধি এবং রিক্রুটিং এজেন্টদের হয়রানী বন্ধে অধ্যাদেশ জারি করেন। এছাড়া বিদেশে চাকরির সুযোগ বৃদ্ধির লক্ষ্যে বাংলাদেশ ওভারসিজ এমপ্লয়মেন্ট লি: (বোয়েলস) নামে একটি পাবলিক লিমিটেড কোম্পানি গঠন করেন। চট্টগ্রামে ইউরিয়া ও যমুনা (তারাকান্দি) সার কারখানা স্থাপন করেন।

খনিজ ও জ্বালানী খাতে উন্নয়ন

আশুগঞ্জে ৬০ মেগাওয়াট শক্তি সম্পন্ন একটি বিদ্যুৎ উৎপাদন প্লান্ট চালু করেন। চট্টগ্রাম, কাপ্তাই, বরিশাল, ঘোড়াশাল এবং আশুগঞ্জে বিদ্যুৎ উৎপাদন স্টেশন নির্মাণ সমাপ্ত করেন। ১২৬টি উপজেলায় বিদ্যুতায়নের কাজ শুরু করেন। ২ বছরে পল্লীবিদ্যুতায়ন বোর্ডের মাধ্যমে ৫ হাজার মাইল বিতরণ লাইন নির্মাণ করেন। বাখরাবাদ গ্যাস ক্ষেত্রের সঙ্গে তিতাস গ্যাসের সংযোগের জন্য ৩২ মাইলব্যাপী ২০ ইঞ্চি লাইন স্থাপনের কাজ শুরু করেন। জয়পুরহাট কঠিন শিলা খনি এবং সিমেন্ট উৎপাদন প্রকল্পের অনুমতি দেন। তিতাস গ্যাসের ৬ নম্বর কূপ চালু এবং ৭ ও ৮ নম্বর কূপের সারফেজ গ্যাদারিং ফ্যাসিলিটিজ সংক্রান্ত দরপত্র আহবান করেন। সীতাকুণ্ডে কূপের খনন কাজ দ্রুততার সাথে শুরু করেন।

ক্রীড়াঙ্গনের উন্নয়ন

ক্রীড়াঙ্গনে ব্যাপক কাজ করেছেন হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ। ছেলে ও মেয়েদের জন্য আলাদাভাবে বয়স ভিত্তিক বিভিন্ন ইভেন্টে টুর্নামেন্ট আয়োজন করেন। প্রতিটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানকে টুর্নামেন্টের আওতায় এনে ভবিষ্যতের জন্য খেলোয়াড় তৈরির পরিকল্পনা ছিল তার। সেসময় শিশুদের জন্য এরশাদ গোল্ডকাপ ফুটবল টুর্নামেন্ট সারা দেশে ব্যাপক সাড়া জাগিয়েছিল। বিভিন্ন ইভেন্টের মানোন্নয়নে ব্যাপক বরাদ্দ এবং পরিকল্পিত ভাবে কোচিংয়ের ব্যবস্থা করেছিলেন।

দূরদর্শী এরশাদ দেশের একমাত্র ক্রীড়া শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বিকেএসপি প্রতিষ্ঠা করেন। আজ সার্বিক আল হাসান, মুশফিকুর রহিম, নাসির হোসেন, এনামুল হক বিজয়, সৈম্য সরকার, মমিনুল হকের মত বিশ্বখ্যাত তারকা ক্রিকেটর তৈরি হচ্ছে বিকেএসপিতে।

এছাড়া বাংলাদেশের প্রথম টেস্ট অধিনায়ক নাঈমুর রহমান, জাতীয় ক্রিকেটার আল শাহরিয়ার, নিয়ামুর রশীদ রাহুল, সজল চৌধুরী, আবদুর রাজ্জাক, নাঈম ইসলাম, নাজমুল হোসেন, রাকিবুল হাসান, সাব্বির খান, সোহরাওয়ার্দী, শামসুর রহমান, মোহাম্মাদ মিঠুনসহ অসংখ্য ক্রিকেটর তৈরি হয়েছে বিকেএসপি থেকে।

মিরপুরে দ্বিতীয় জাতীয় স্টেডিয়াম এবং ইনডোর স্টেডিয়াম নির্মাণ করেন। বনানীতে আর্মি স্টেডিয়াম নির্মাণ করেন। বর্তমান বঙ্গবন্ধু জাতীয় স্টেডিয়াম সংস্কার ও আধুনিকায়ন করেন পল্লীবন্ধু। পুরান ঢাকার ৩টি খেলার মাঠ এবং ২৮০টি বিপণী বিশিষ্ট ধুপখোলা কমপ্লেক্স তৈরি করেন। ঢাকায় এক ডজনের বেশি শিশু পার্ক নির্মাণ করেন।

জাতিসংঘ শান্তি মিশনে সৈন্য

সকল রাজনৈতিক দলের বিরোধিতা উপেক্ষা করে জাতিসংঘ শান্তি মিশনে সৈন্য পাঠিয়ে দূরদর্শিতার স্বাক্ষর রেখেছেন পল্লীবন্ধু এরশাদ। এখন বাংলাদেশের প্রতিটি সৈনিক স্বপ্ন দেখেন শান্তি মিশনে কাজ করার। আর জাতিসংঘ শান্তি মিশনে শ্রম, মেধা আর সততায় বাংলাদেশ সেনাবাহিনীসহ বিভিন্ন বাহিনীর সদস্যরা বাংলাদেশের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করেছে।

ধর্মীয় সম্প্রীতি রক্ষা

সাম্প্রদায়িক অসহিষ্ণুতাকে ঘৃণা করতেন হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ। ধর্মীয় সম্প্রীতি রক্ষায় নানা উদ্যোগ নিয়েছিলেন পল্লীবন্ধু। প্রতিটি ধর্মের অনুসারীদের জন্য কল্যাণময় কাজ করেছেন তিনি। প্রতিটি ধর্মের অনুসারীদের জন্য তাঁর ছিল অকৃত্রিম শ্রদ্ধাবোধ। জুমার নামাজকে বলা হয় গরীবের হজ্জ, তাই শুক্রবারকে সাপ্তাহিক ছুটির দিন ঘোষণা করেন পল্লীবন্ধু এরশাদ। এর আগে সাপ্তাহিক ছুটি ছিল রোববার। ১৯৮৮ সালে সংখ্যা গরিষ্ঠ মুসলমানদের বাংলাদেশে ইসলামকে রাষ্ট্রধর্ম ঘোষণা দেন তিনি।

বায়তুল মোকাররম মসজিদের ভবন সম্প্রসারণ এবং সৌন্দর্যবর্ধন করেন। বায়তুল মোকাররমকে জাতীয় মসজিদ ঘোষণা করেন। যাকাত তহবিল এবং যাকাত বোর্ড গঠন করেন। রেডিও এবং টেলিভিশনে আজান শুরু করেন পল্লীবন্ধু। ২ কোটি টাকা বরাদ্দ দিয়ে হিন্দু ধর্মকল্যাণ ট্রাষ্ট এবং বৌদ্ধ ও খৃষ্টান ধর্মের প্রত্যেকটির জন্য ১ কোটি টাকা বরাদ্দ দিয়ে পৃথক কল্যাণ ট্রাষ্ট গঠন করেন। মসজিদ, মন্দির, গির্জা, প্যাগোডাসহ সকল ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের বিদ্যুৎ ও পানির বিল মকুফ করেন। প্রতিটি পূজা পার্বণে সরকারী বরাদ্দ বৃদ্ধি এবং নিরাপত্তা নিশ্চিতে ব্যাপক উদ্যোগ নেন পল্লীবন্ধু।

পহেলা বৈশাখ ছুটি ঘোষণা

সপ্তম শতাব্দীতে রাজা শশাঙ্ক এবং পরবর্তীতে সম্রাট আকবর খাজনা আদায়ের জন্য বাংলা বর্ষপঞ্জি শুরু করলেও পহেলা বৈশাখ এখন সকল ধর্ম ও বর্ণের বাঙালীর প্রাণের উৎসব। সাবেক রাষ্ট্রপতি এরশাদই পহেলা বৈশাখকে সরকারি ছুটির দিন ঘোষণা করেন। সরকারি ছুটিতে বাঙালীর সবচেয়ে বড় উৎসবে পরিণত হয় পহেলা বৈশাখ। পৃথিবীর সকল প্রান্তের বাঙালীরা দিনটিকে উৎসবমুখর করেন নানা আয়োজনে। এরশাদই ভেবে ছিলেন শুধু পহেলা বৈশাখেই বাংলার হিন্দু-মুসলিম-বৌদ্ধ-খৃষ্টানকে উৎসবের এক সূতায় বাঁধতে।

গণমাধ্যমের উন্নয়ন

গণমাধ্যমের জন্য জাতীয় প্রেস কমিশন গঠন করেন হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ। এছাড়া রেডিও এবং টেলিভিশন একত্রীকরণের মাধ্যমে জাতীয় সম্প্রচার সেল গঠন করেন। সরকার নিয়ন্ত্রিত দি বাংলাদেশ অবজারভার এবং চিত্রালীতে পূর্বতন মালিকানায় ফিরিয়ে দেন। দৈনিক বাংলা, বিচিত্রা এবং বাংলাদেশ টাইমসের স্বাধীন ব্যবস্থাপনার জন্য “দৈনিক বাংলা ট্রাষ্ট” ও “বাংলাদেশ টাইমস ট্রাষ্ট” নামে ২টি ট্রাষ্ট গঠন করেন।

ঐতিহাসিক ও অহংকারের স্থাপনা

মুজিবনগরে জাতীয় স্মৃতিসৌধ নির্মাণ করেন। স্বল্প সময়ে সাভারে জাতীয় স্মৃতিসৌধ নির্মাণ সম্পন্ন করেন। কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার চত্বর সম্প্রসারণ করেন। সংসদ ভবন এলাকার উন্নয়ন ও রমনায় জাতীয় তিন নেতার মাজার নির্মাণ সম্পন্ন করেন। পুরনো গণভবনকে রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবনে রূপান্তর করেন। ঐতিহাসিক আহসান মঞ্জিল সংস্কার করেন। জাতীয় ঈদগাহ এবং সচিবালয়ের সামনে নাগরিক সংবর্ধনা কেন্দ্র নির্মাণ করেন। নগর ভবন ও পুলিশ সদর দফতর নির্মাণ করেন। বিসিএস একাডেমি ও লোক প্রশাসন কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করেন।

হাজারো কীর্তি

এছাড়া নানামুখী উন্নয়নে অবদান রেখেছেন পল্লীবন্ধু এরশাদ। রাজধানীসহ সারাদেশে এরশাদের কীর্তির অসংখ্য স্মৃতি অক্ষয় হয়ে আছে। তারমধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে, মিরপুর ও গুলশান পৌরসভাকে ঢাকা সিটি কর্পোরেশনে অন্তর্ভুক্ত করেন। চট্টগ্রাম পৌরসভাকে সিটি কর্পোরেশনে উন্নীত করেন হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ।

আত্মসমর্পণকারী পার্বত্য বিপথগামী উপজাতীয়দের সাধারণ ক্ষমা এবং পুনর্বাসনে বিশেষ সুবিধার ব্যবস্থা করেছেন। ন্যাশনাল ওয়াটার মাষ্টার প্ল্যান প্রণয়ন করেন। ১৯৮৫ সালের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করে তিস্তা বাঁধ প্রকল্প নির্মাণ এগিয়ে নেন।

উত্তরা ও বারিধারায় নতুন প্লট বরাদ্দ দেন। নগরীর পানি ও বিদ্যুৎ লাইনের উন্নয়ন করেন। প্রতিটি সড়ক ও অলিগলিতে বৈদ্যুতিক বাতির ব্যবস্থা করেন। নগরীতে গ্যাস সরবরাহের ব্যবস্থা করেন। এছাড়া উপজেলা ভিত্তিক তিন স্তরের প্রশাসন ব্যবস্থা চালু করেন। জ্যেষ্ঠতার ভিত্তিতে বন্ধ থাকা পদোন্নতি চালুন করেন। গেজেটেড পদে মহিলাদের জন্য ২০ ভাগ পদ সংরক্ষণ করেন।

জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের পরিবারের জন্য রাজধানীর বনানীতে বাড়ি বরাদ্দ দেন। পথ শিশুদের জন্য পথকলি ট্রাষ্ট গঠন করেন। নয় বছর রাষ্ট্র পরিচলানাকালে পল্লীবন্ধু অজস্র কল্যাণময় উদ্যোগ গ্রহণ করেন। যার সুফল দেশ ও জাতী সম্মানের সঙ্গে আজীবন উপভোগ করবে।

লেখক: খন্দকার দেলোয়ার জালালী, সাংবাদিক এবং প্রয়াত রাষ্ট্রপতি পল্লীবন্ধু হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের সাবেক ডেপুটি প্রেস সেক্রেটারি

Leave A Reply

Your email address will not be published.