একটি বাতি ৯৮ হাজার টাকা, খাল-নর্দমা-সড়ক ধরলেই চার কোটি!
ঢাকা: কখনো একটি কড়ইগাছের দাম চার কোটি টাকা, একটি মাইক্রোস্কোপের দাম ১৪ লাখ টাকা, একটি বালিশের দাম ২৭ হাজার ৭০০ টাকা, আবার কখনো একটি গগলসের দাম পাঁচ হাজার টাকা, পিপিইর দাম চার হাজার ৭০০ টাকা নির্ধারণ করে দেশব্যাপী আলোচনা-সমালোচনার জন্ম দিয়েছে সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রণালয়। সরকারের বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্পে এমন অস্বাভাবিক খরচ গণমাধ্যমে প্রকাশের পর বিব্রত হতে হয়েছে সরকারকে। গণমাধ্যমে প্রকাশ পাওয়া খবরকে যৌক্তিক ধরে পরে প্রকল্পের অস্বাভাবিক খরচ সংশোধনও করা হয়েছে; কিন্তু তার পরও কিছুতেই উন্নয়ন প্রকল্পে উপকরণ কেনায় অস্বাভাবিক খরচের প্রবণতা থামানো যাচ্ছে না।
ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনে নতুনভাবে অন্তর্ভুক্ত ১৮টি ওয়ার্ডের অবকাঠামো উন্নয়নে নেওয়া একটি প্রকল্পে প্রতিটি এলইডি বাতি কিনতে খরচ ধরা হয়েছে ৯৮ হাজার টাকা। ওই ১৮টি ওয়ার্ডের জন্য ১২ হাজার ২১৮টি এলইডি বাতি কেনা হবে। এ জন্য বরাদ্দ রাখা হয়েছে ১২০ কোটি টাকা। সে হিসাবে প্রতিটি এলইডি বাতি কিনতে খরচ পড়বে ৯৮ হাজার টাকা, যা বর্তমান বাজারমূল্যের প্রায় দ্বিগুণ। এমনকি ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের আওতায় চলমান একটি প্রকল্পে প্রতিটি এলইডি বাতি কেনাসহ স্থাপনে খরচ হয়েছে ৬০ হাজার টাকা। সে হিসাবে প্রস্তাবিত প্রতিটি এলইডি বাতিতে খরচ বেশি দেখানো হয়েছে ৩৮ হাজার টাকা। শুধু এলইডি বাতিই নয়, ওই ১৮টি ওয়ার্ডের অবকাঠামো উন্নয়নে নেওয়া প্রস্তাবিত প্রকল্পে খাল উন্নয়ন, নর্দমা উন্নয়ন ও রাস্তা উন্নয়নেও অস্বাভাবিক খরচ দেখানো হয়েছে।
‘ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের নতুনভাবে অন্তর্ভুক্ত ১৮টি ওয়ার্ডের সড়ক অবকাঠামো ও ড্রেনেজব্যবস্থার উন্নয়ন’ শিরোনামের প্রকল্পটির আওতায় বিভিন্ন খাতে যেসব খরচ দেখানো হয়েছে, তা সমজাতীয় প্রকল্পের সঙ্গে সামঞ্জস্য পূর্ণ নয়। প্রস্তাবিত প্রকল্পটির মোট ব্যয় ধরা হয়েছে চার হাজার ২৫ কোটি টাকা। যেটি এযাবৎকালে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের জন্য সবচেয়ে বড় প্রকল্প। প্রকল্পটি বাস্তবায়নে পুরো টাকাই রাষ্ট্রীয় কোষাগার থেকে জোগান দেওয়া হবে। প্রস্তাবিত প্রকল্পটি চূড়ান্ত অনুমোদনের জন্য আজ মঙ্গলবার জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) সভায় উত্থাপনের কথা রয়েছে।
ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের প্রতি এলইডি বাতি কেনা বাবদ ৯৮ হাজার টাকা খরচের প্রস্তাবের সূত্র ধরে এক দৈনিক পত্রিকার প্রতিবেদক দেশীয় একাধিক এলইডি বাতি উৎপাদনকারী কম্পানির সঙ্গে যোগাযোগ করেন। একই সঙ্গে বিশ্বের প্রথমসারির তিনটি এলইডি উৎপাদনকারী কম্পানির প্রতিটি এলইডি বাতির খরচের তথ্য সংগ্রহ করা হয়। এ ছাড়া ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন, চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের সমজাতীয় প্রকল্প পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, উত্তর সিটি করপোরেশনের প্রস্তাবিত প্রকল্পে প্রতিটি এলইডি বাতির যে খরচ দেখানো হয়েছে, তা বর্তমান বাজারমূল্যের চেয়ে অনেক বেশি। মানের দিক থেকে বিশ্বে এলইডি বাতি উৎপাদনে সেরা অবস্থানে রয়েছে যুক্তরাজ্যের থ্রন কম্পানি, জার্মানির অস্রাম এবং একই দেশের স্রেডার কম্পানি। ঢাকা দক্ষিণ ও উত্তর সিটি করপোরেশনের বিদ্যমান রাস্তার দূরত্ব ও উচ্চতার সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে ১০০ থেকে ১৫০ ওয়াটের প্রতিটি এলইডি বাতি আমদানিতে খরচ পড়ে ৪০ থেকে ৪৫ হাজার টাকা। এর সঙ্গে পোল, সুইচ বকস, কেবলসহ আনুষঙ্গিক খরচ পড়ে আরো ২০ হাজার টাকা।
যুক্তরাজ্যের থ্রন কম্পানির বাংলাদেশের এজেন্ট প্রকৌশলী মাহাবুব হোসেন, যিনি একই সঙ্গে ট্রেড মেজিট্রিক লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক। চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনে তিনি এলইডি বাতি লাগানোর কাজ পেয়েছেন গত বছর। সেখানে প্রতিটি এলইডি বাতি কেনা এবং স্থাপনে খরচ পড়েছে ৬০ হাজার টাকার মতো। অথচ ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের প্রস্তাবিত প্রকল্পে প্রতিটি এলইডি বাতি কেনায় খরচ দেখানো হয়েছে ৯৮ হাজার টাকা।
এলইডি বাতির দাম নিয়ে কথা হয় বাংলাদেশের ৫০ শতাংশ এলইডি বাতির চাহিদা মেটানো দেশীয় কম্পানি সুপারস্টারের হেড অব করপোরেট ফয়েজ উদ্দিন আহমেদের সঙ্গে। তিনি একটি গণমাধ্যমকে বলেন, ‘৬০ থেকে ১০০ ওয়াটের এলইডি বাতির দাম ১০ থেকে ১৬ হাজার টাকার মধ্যে।’ ১০০ থেকে ১৫০ ওয়াট এলইডি তারা বিক্রি করেন ১৬ থেকে ১৮ হাজার টাকা। গণপূর্ত অধিদপ্তরসহ সরকারের বিভিন্ন সংস্থায় তাঁরা এলইডি বাতি স্থাপন করেছেন বলে জানান ফয়েজ উদ্দিন। তাঁর মতে, জার্মানি থেকেও যদি এলইডি বাতি আমদানি করা হয়, তবে ১০০ থেকে ১৫০ ওয়াটের সবচেয়ে ভালোমানের এলইডি বাতির দাম কিছুতেই ৯৮ হাজার টাকা হতে পারে না। দূরত্ব-উচ্চতা মাথায় রেখে এবং বজ পাত থেকে রক্ষা উপযোগী করেও যদি এলইডি বাতি বানানো হয়, সে ক্ষেত্রে প্রতিটি এলইডি বাতির দাম ৩০ হাজার টাকার মধ্যে থাকবে।
হেভেলস কম্পানির প্রতিনিধি রেজাউল করিম জানান, শেরপুর পৌরসভায় ৬০ ওয়াটের এলইডি বাতি তাঁরা বিক্রি করেছেন সাত থেকে ১০ হাজার টাকায়। বাংলাদেশে বর্তমানে ১০০ থেকে ১৫০ ওয়াটের মধ্যেই এলইডি বাতি বসানো হয়।
এ ছাড়া উত্তর সিটির ১৮টি ওয়ার্ডের অবকাঠামো উন্নয়নে অন্যান্য খাতেও যেসব খরচ দেখানো হয়েছে, তাতেও অস্বাভাবিক খরচ দেখানো হয়েছে। এই প্রকল্পের আওতায় সাড়ে ২৮ কিলোমিটার খাল উন্নয়ন করা হবে। এ জন্য খরচ ধরা হয়েছে ৮৩ কোটি টাকা। সে হিসাবে প্রতি কিলোমিটার খাল উন্নয়নে খরচ পড়বে প্রায় তিন কোটি টাকা। আর ২৩৪ কিলোমিটার নর্দমা নির্মাণ ও উন্নয়ন করা হবে। এ জন্য খরচ ধরা হয়েছে এক হাজার ৫১ কোটি টাকা। সে হিসাবে প্রতি কিলোমিটার নর্দমা নির্মাণ ও উন্নয়নে খরচ হবে সাড়ে চার কোটি টাকা। রাস্তা নির্মাণ ও উন্নয়ন করা হবে ১৮৩ কিলোমিটার। খরচ ধরা হয়েছে ৭৪৩ কোটি টাকা। সে হিসাবে প্রতি কিলোমিটার রাস্তা উন্নয়ন ও নির্মাণে খরচ হবে চার কোটি টাকা। এর বাইরে ১০ জন কর্মকর্তা বিদেশ ভ্রমণে যাবেন। এর জন্য খরচ ধরা হয়েছে এক কোটি টাকা। প্রকল্পটির আওতায় ৭০ একর জমি অধিগ্রহণ ও স্থাপনার ক্ষতিপূরণ বাবদ খরচ ধরা হয়েছে এক হাজার ৮৪৮ কোটি টাকা।
অনুসন্ধানে দেখা গেছে, ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনে বর্তমানে একটি প্রকল্পের আওতায় ২৩৯ কিলোমিটার সড়ক উন্নয়ন ও নির্মাণের কাজ চলছে। এই প্রকল্পে রাস্তা উন্নয়ন ও নির্মাণে প্রতি কিলোমিটার খরচ হচ্ছে এক কোটি ৪৩ লাখ টাকা। অন্যদিকে দুই বছর আগে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন বাস্তবায়িত গুলশান, বনানী, বারিধারা কূটনৈতিক এলাকায় সড়ক, নর্দমা ও ফুটপাত নির্মাণ এবং উন্নয়ন শিরোনামের একটি প্রকল্পের আওতায় দুই লেনের প্রতি কিলোমিটার সড়ক নির্মাণ এবং উন্নয়নে খরচ হয়েছিল দুই কোটি ২৪ লাখ টাকা। অথচ দুই বছরের ব্যবধানে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন এখন প্রস্তাবিত সড়ক নির্মাণ ও উন্নয়নে কিলোমিটারপ্রতি খরচ দেখাচ্ছে চার কোটি টাকা।
অন্যদিকে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন বাস্তবায়িত গুলশান, বনানী, বারিধারা কূটনৈতিক এলাকায় সড়ক, নর্দমা ও ফুটপাত নির্মাণ এবং উন্নয়ন শিরোনামের একটি প্রকল্পের আওতায় ড্রেন ও নর্দমা উন্নয়নে প্রতি কিলোমিটারে খরচ হয়েছিল এক কোটি ৯৭ লাখ টাকা। এ ছাড়া ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের বিভিন্ন অঞ্চলের ক্ষতিগ্রস্ত সড়ক, নর্দমা ফুটপাত নির্মাণ উন্নয়নসহ সড়ক নিরাপত্তা নামের আলাদা একটি প্রকল্পে ড্রেন ও নর্দমা উন্নয়নে কিলোমিটারপ্রতি খরচ ধরা হয়েছিল এক কোটি ৮৪ লাখ টাকা। অথচ ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন প্রস্তাবিত প্রকল্পে ড্রেন ও নর্দমা উন্নয়নে কিলোমিটারপ্রতি খরচ ধরা হয়েছে সাড়ে চার কোটি টাকা। অবশ্য ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন থেকে বলা হয়েছে, ডিএনসিসি রেট শিডিউল ২০১৯-এর আলোকে এসব দাম নির্ধারণ করা হয়েছে।
সার্বিক বিষয়ে জানতে চাইলে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী শরীফ উদ্দিন বলেন, ‘রাস্তা, নর্দমা, খাল উন্নয়নের জন্য আমরা যে খরচ ধরেছি, তা অনেক যাচাই-বাছাই করে, পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে বিচার-বিশ্লেষণ করেই ধরেছি। তবে মনে রাখতে হবে, এটিই চূড়ান্ত হিসাব নয়। কাজ করতে গিয়ে পরে এই খরচ আরো বাড়তে পারে, আবার কমতেও পারে। এমনও হতে পারে, দরপত্র আহ্বান করতে দিয়ে দাম কমে যাবে। এটি চূড়ান্ত প্রস্তাব নয়।’
এলইডি বাতির দামের বিষয়ে জানতে চাইলে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী (বিদ্যুৎ) রফিকুল ইসলাম বলেন, ‘৯৮ হাজার টাকার মধ্যে এলইডি বাতি কেনা, পোল, কেবল, সুইচ, আর্থিং—সব খরচই ধরা হয়েছে। তাই যে দাম ধরা হয়েছে, সেটি যৌক্তিক।’
ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের সমজাতীয় প্রকল্পে প্রতিটি এলইডি বাতি কেনাসহ স্থাপনে খরচ হয়েছে ৫০ হাজার টাকার মধ্যে, বিষয়টি তুলে ধরলে রফিকুল ইসলাম বলেন, ‘দক্ষিণ সিটি করপোরেশন চীন থেকে নিম্নমানের এলইডি বাতি আমদানি করেছে। আমরা ইউরোপ থেকে এলইডি বাতি আমদানি করব।’
এলইডি বাতি কেনা এবং আনুষঙ্গিক খরচ আলাদা ধরা হয়। এ ক্ষেত্রে কেন সব খরচ একসঙ্গে ধরা হয়েছে—জানতে চাইলে রফিকুল ইসলাম আর কোনো কথা বলতে অপারগতা প্রকাশ করে তাঁর অফিসে চায়ের দাওয়াত দেন।
২০১১ সালের ৪ ডিসেম্বর ঢাকা সিটি করপোরেশনকে উত্তর ও দক্ষিণ—এই দুই অংশে বিভক্ত করা হয়। ২০১৬ সালে আলাদা আইনের মাধ্যমে উত্তর সিটি করপোরেশনের আওতায় হরিরামপুর ইউনিয়ন, উত্তরখান, দক্ষিণখান, বাড্ডার মোট ১৮টি ওয়ার্ড অন্তর্ভুক্ত করা হয়। ফলে উত্তর সিটি করপোরেশনের পুরনো ৮২ বর্গকিলোমিটারের সঙ্গে নতুন ১১৫ বর্গকিলোমিটার যুক্ত হয়। প্রস্তাবিত ওয়ার্ডগুলোর রাস্তাঘাট অত্যন্ত নাজুক। পানি নিষ্কাশনব্যবস্থা দুর্বল। পাকা রাস্তাগুলো ব্যবহারের অনুপযোগী। রাস্তার ওপরে নেই সড়কবাতি। এসব কারণে এসব এলাকায় বসবাস করা মানুষদের প্রতিদিন চরম ভোগান্তি পোহাতে হয়। সে জন্য প্রস্তাবিত চার হাজার ২৫ কোটি টাকার প্রকল্পটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হলে উত্তর সিটি করপোরেশনের বর্ধিত এলাকাগুলোর অবস্থার উন্নতি ঘটবে। প্রকল্পটি আজ অনুমোদন পেলে শিগগিরই কাজ শুরু করতে চায় উত্তর সিটি করপোরেশন। কিন্তু মেগাপ্রকল্পে সরকার প্রতিবছর কাঙ্ক্ষিত টাকা বরাদ্দ দিতে পারবে কি না, তা নিয়ে সংশয় প্রকাশ করেন উত্তর সিটি করপোরেশনের অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী শরীফ উদ্দিন। কারণ কোভিড-১৯-এর কারণে সরকারের রাজস্ব আদায় কমে গেছে। সূত্র : কালের কণ্ঠ