নিউইয়র্কে করোনায় মৃত্যুর তালিকায় নেই অনেক প্রবাসীর নাম

270

নিউইয়র্ক থেকে: করোনা মহামারির মধ্য দিয়ে নিউইয়র্কের চিকিৎসা-ব্যবস্থার বেহাল চিত্রের প্রকাশ ঘটেছে। মার্চের তৃতীয় সপ্তাহে এই সিটিতে বহু মানুষ গুরুতরভাবে আক্রান্ত হয়। একটি হাসপাতালেও তিল ধারণের ঠাঁই ছিল না। এজন্যে অনেক রোগী হাসপাতালের জরুরী বিভাগের ওয়েটিং রুমেই মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েছে। 

আর যারাও আইসিইউতে ঠাঁই পেয়েছিলো, তাদেরও সিংহভাগই ভেন্টিলেশনের অভাবে মারা গেছে। এ নিয়ে কঠোর সমালোচনা হলেও পরিস্থিতির ভয়াবহতার কাছে সকলেই ছিলেন অসহায়।  সে সময় দৈনিক ৮০০ জনের মত মারা গেছে বলে স্বাস্থ্য বিভাগ জানালেও বাস্তবে সে সংখ্যা আরো বেশী ছিল। কারণ, অনেকেই হাসপাতালে যাবার সুযোগ পায়নি। নিজ বাসায় মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েছে যারা, তারা করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছিল-এ তথ্য সিটি প্রশাসনে নেই। এমনকি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায়ও যারা মারা গেছে তাদেরও বড় একটি অংশ করোনায় মৃতদের তালিকায় উঠেনি। নিউইয়র্ক সিটি স্বাস্থ্য বিভাগের কর্মকর্তারা ১১ জুলাই শনিবার এ সংবাদদাতাকে জানান, মোট ২ লাখ ২৩ হাজার ৩৮২ জন আক্রান্ত হয়েছিল করোনায়। এরমধ্যে করোনায় মারা গেছে ১৮ হাজার ৬৬৭ জন।

স্বাস্থ্য বিভাগের নথিতে একই সময়ে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যাওয়া আরো ৪৬১১ জনের নাম রয়েছে করোনা-উপসর্গ নিয়ে মৃত্যুবরণকারি তালিকায়। অর্থাৎ এরা যে করোনায় মারা গেছেন সে ব্যাপারে নিশ্চিত হতে পারেনি চিকিৎসকরা। এভাবেই  মৃত্যু নিয়েও এক ধরনের উদাসিনতার অভিযোগ রয়েছে। আর এমন তালিকায় যারা রয়েছে তাদের সিংহভাগই অভিবাসী অর্থাৎ সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের সদস্য। এপ্রিলের শুরুতেই আক্রান্তদের হাসপাতালে ভর্তি এবং মৃতদের তালিকা নিয়ে কর্তৃপক্ষের নজীরবিহীন উদাসীনতা ও রহস্যজনক আচরণের নিন্দা ও প্রতিবাদ জানিয়েছেন ‘সাউথ এশিয়ান ফান্ড ফর এডুকেশন, স্কলারশিপ এ্যান্ড ট্রেনিং’ তথা স্যাফেস্ট নামক একটি সংস্থার প্রতিষ্ঠাতা ও প্রেসিডেন্ট মাজেদা এ উদ্দিন। সে প্রতিবাদের ভাষা এখন আরো জোরালো হয়েছে অন্য কমিউনিটি থেকেও। কারণ, হিসাবের বাইরে থাকা মানুষগুলো হচ্ছেন কৃষ্ণাঙ্গ অথবা বাদামী রংয়ের। স্প্যানিশ সম্প্রদায়ও উপেক্ষিত হয়েছে নানাভাবে। 

স্মরণ করা যেতে পারে, মার্চ-এপ্রিল-মে মাসের মাঝামাঝি সময়টি ছিল নিউইয়র্ক সিটির মানুষদের জন্যে খুবই সংকটের। লাশের মিছিল হয়েছে। গোরস্থানে দাফনের সিরিয়াল পাওয়া যেত না। দৈনিক ৮ শতাধিক মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে করোনায়। মহামারির চূড়ান্ত এই ছোবলের সময় সকলেই যখন ভীত-সন্ত্রস্ত, গভীর এক হতাশায় জর্জরিত, তেমনি সময়ে আক্রান্তদের পাশে ছিলেন মধ্যবয়েসী এই সমাজকর্মী মাজেদা এ উদ্দিন। স্বাস্থ্যবিধি মেনে আত্মীয়-স্বজনহীন আক্রান্তদের বাসায় খাবার পৌঁছে দিয়েছেন। সিটি প্রশাসন এসে যাদেরকে কোয়ারেন্টিনে নিয়েছে হোটেল-শিবিরে, তাদের কাছেও খাবার বিতরণ করেছেন সাধ্য অনুযায়ী। 

বোর্ড অব ইলেকশনের কমিশনার ও স্যাফেস্ট এর প্রতিষ্ঠাতা মাজেদা উদ্দিন বললেন তার অসহনীয় দিনগুলোর কথা। নিজেও আক্রান্তের পর্যায়ে গিয়েছিলেন। তবুও দমেননি। কারণ, অনেক মহিলাই নি:সঙ্গ কিংবা স্বামীর সাথে ঝগড়ার পরিপ্রেক্ষিতে আগে থেকেই সিটির আশ্রয় কেন্দ্রে বাস করছিলেন। এর অনেকেরই হাসপাতালে ফোন করার মত অভিজ্ঞতা বা সুযোগ ছিল না। মাজেদার কাছে সংবাদ পাঠিয়ে তারা নিশ্চিন্ত থাকার চেষ্টা করেন। সেই মাজেদাই ফোন করেন হাসপাতালে। মে মাস পর্যন্ত হাসপাতালে সীট পাওয়া কঠিন একটি বিড়ম্বনা ছিল। বিক্রমপুরের সন্তান মাজেদা বললেন, এই সিটির চিকিৎসা-ব্যবস্থাসহ মানবিকতা নিয়ে আমার মধ্যে যে অহংবোধ ছিল, তা ভেঙ্গে তছনছ হয়ে গেছে করোনাকালে। চোখের সামনে প্রবাসীদের অনেককেই এলমহার্স্ট হাসপাতালের জরুরী বিভাগের ওয়েটিং রুমে ছটফট করতে করতে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়তে দেখেছি। 

কোনমতে হাসপাতালে ভর্তির সুযোগ ঘটলেও অক্সিজেন/ভেন্টিলেশনের অভাবে প্রাণ ঝরেছে অনেকের। এরফলে করোনায় মৃত্যু হওয়া সত্বেও স্বাস্থ্য দফতরের নথিতে অনেক প্রবাসীর নাম এখন পর্যন্ত উঠেনি। এ সংবাদদাতার সাথে কথা বলার সময় মাজেদার সাথে ছিলেন বোরহানউদ্দিন চাকলাদার। তার স্ত্রী তিষা চাকলাদার মারা গেছেন ২৩ মার্চ। এখন পর্যন্ত সার্টিফিকেট পাননি করোনায় আক্রান্ত হয়ে মারা যাবার তথ্য সম্বলিত। তার স্ত্রী মারা যাবার সময় ১২, ১১ এবং ৪ বছর বয়েসী তিন সন্তান রেখে গেছেন। তাদের দেখভালের জন্যে নিজে কোন কাজ করতে সক্ষম হচ্ছেন না। অপরদিকে, এখন পর্যন্ত এসাইলাম মঞ্জুর না হওয়ায় এই দু:স্থ পরিবারটি ফেডারেল, স্টেট অথবা সিটির কোন অর্থ সহায়তাও পাচ্ছেন না। অথচ সিটি মেয়র কয়েক সপ্তাহ আগে ঘোষণা দিয়েছেন যে, অভিবাসনের মর্যাদা নেই এমন লোকজনকে মাথাপিছু এক হাজার ডলার করে প্রদান করা হবে। 

মাজেদা বলেন, তিষার মত ২১৪ জন আক্রান্ত হন। এরমধ্যে ৫১ জন কাগজপত্রহীন বাংলাদেশী ছিলেন। মারা গেছেন ২৭ জন। সকলেরই রেখে যাওয়া পরিবারের সদস্যরা খুবই কষ্টে দিনাতিপাত করছেন। বৈধ কাগজ না থাকায় করোনা-মুক্ত সময়ে তারা কাজ পাবেন-এমন কোন নিশ্চয়তা এখন আর নেই। কারণ, সকলেই মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় এবং সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখে রেস্টুরেন্ট, ব্যবসা পরিচালনা করতে কর্মচারির সংখ্যা অর্ধেকে নেমে এসেছে। 

মাজেদা বললেন, ইতিমধ্যেই আমি কংগ্রেসওম্যান গ্রেস মেং-এর সাথে দুর্দশায় পতিত কাগজপত্রহীন অভিবাসীদের জন্যে কিছু করার অনুরোধ রেখেছি। কিন্তু স্বাস্থ্য বিভাগ যদি করোনায় মৃত্যুর সার্টিফিকেট ইস্যু না করে তাহলে কোনকিছুই সম্ভব হবে না। সরেজমিনে খোঁজ-খবর নেয়ার ভিত্তিতে মাজেদা বললেন যে, তার কাছেই ৯০০ জন প্রবাসীর তালিকা রয়েছে, যারা করোনায় বন্দিজীবনে দুর্বিসহ পরিস্থিতির মধ্যে পড়েছেন। মাজেদা বিশেষভাবে উল্লেখ করেন যে, এই সিটিতে বসবাসরত কাগজপত্রহীন অভিবাসীরাও বছরে প্রায় ৭.৬ মিলিয়ন ডলারের ট্যাক্স দিচ্ছেন। অথচ এই ক্রান্তিকালে কোন সহযোগিতা তারা পাননি। 

Leave A Reply

Your email address will not be published.