রাজধানীতে ভাড়া কিছুটা কমিয়েও মিলছে না ভাড়াটিয়া

229

ঢাকা: রাজধানীর বাড্ডা এলাকার একটি বাড়ির মালিক এরশাদ আলী। বাড়িটি বড় রাস্তা-সংলগ্ন হওয়ায় বছরের কোনো সময়ই কোনো ফ্ল্যাট ফাঁকা থাকে না। এমন কোনো মাস যায়নি, যে মাসে তার কোনো ফ্ল্যাট ভাড়াটিয়ার অভাবে ফাঁকা গেছে। কিন্তু ছন্দের পতন হয়েছে এবার। করোনাভাইরাসের কারণে সৃষ্ট পরিস্থিতিতে গত দুই মাস ধরে তার দুটি ফ্ল্যাট ফাঁকা পড়ে আছে। নতুন মাসের (জুলাই) তিন দিনও পার হয়েছে। কিন্তু এখন পর্যন্ত ভাড়াটিয়া পাননি তিনি।

ভাড়াটিয়ার খোঁজে বাসার সামনে শুধু ‘টু লেট’ টাঙিয়ে থেমে থাকেননি এরশাদ আলী। ‘বাসা ভাড়া হবে’— এমন ছোট ছোট পোস্টার লাগিয়েছেন পাড়া-মহল্লা, অলি-গলি, বড় রাস্তার পাশে। তবু কারও আগ্রহ দেখছেন না তিনি।

শুধু এরশাদ আলীর বাড়িই নয়, করোনাভাইরাস অর্থনৈতিক কার্যক্রমে ধাক্কা দিয়ে যে পরিস্থিতির সৃষ্টি করেছে, তাতে রাজধানীর বেশিরভাগ বাড়িতেই এখন ভাড়াটিয়া সংকট দেখা দিয়েছে। সেজন্য সিংগভাগ বাড়িতে ঝুলছে বাসা ভাড়া দেয়ার বিজ্ঞাপন ‘টু লেট’।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, করোনার কারণে অনেক মানুষ কাজ হারিয়েছেন, অনেক মানুষের শ্রেণি কাঠামোর পরিবর্তন হয়েছে। নতুন করে অনেক মানুষ হতদরিদ্র হয়েছেন, ফলে আগের ভাড়ার ভার বইতে পারছেন না তারা। সেজন্য ছেড়ে দিচ্ছেন বাসা, ছেড়ে দিচ্ছেন ঢাকাও। আর ভাড়াটিয়ারা বাসা ছেড়ে দেয়ায় এবং নতুন ভাড়াটিয়া না পেয়ে বিপদে পড়েছেন বাড়ির মালিকরা।

এরশাদ আলী গণমাধ্যমকে বলেন, আমার ছয়তলার বাসার দুটি ফ্ল্যাট বিগত দুই মাস ধরে ফাঁকা, আর চলতি মাস ধরলে তিন মাস। ওই দুই ফ্ল্যাটে আগে যারা ছিলেন তারা চাকরি হারানোর কারণে বাসা ছেড়ে দিয়ে চলে গেছেন। এরপর থেকে আর কোনো ভাড়াটিয়া ওঠেনি। সে কারণে পড়েছি বিপদে। কোনোভাবেই ভাড়াটিয়া পাচ্ছি না, এমনকি ভাড়া দুই হাজার টাকা কমিয়েও দিয়েছি। তবু কোনো ভাড়াটিয়া পাচ্ছি না।

“বাসা ভাড়ার আয়ের ওপরই সংসার চলে, সেই সঙ্গে নানা খরচও আছে। যে কারণে বিভিন্ন জায়গায় ‘টু লেট’ পোস্টার লাগিয়েছি। তবু বাসা ভাড়া নেয়ার জন্য মানুষ খুঁজে পাচ্ছি না। সবমিলিয়ে বিপদে পড়েছেন ঢাকায় আমার মতো অন্য বাড়ির মালিকরাও।”

কী কারণে রাজধানীর এই অবস্থা— জানতে চাইলে বনশ্রীর বাড়ির মালিক জামাল আহমেদ বলেন, সাধারণ ছুটি বা লকডাউনের কারণে ভাড়াটিয়ারা অনেকেই তাদের পরিবারের সদস্যদের গ্রামের বাড়ি পাঠিয়ে দিয়েছেন আগেই। পরিবারের উপার্জনের ব্যক্তিটি পরে বাসা ছেড়ে দিয়ে অন্য কোনো মেস বা ছোট বাসায় উঠেছেন। যে কারণে অনেক বাসা ফাঁকা হয়ে গেছে। এছাড়া এই পরিস্থিতিতে নতুন কেউ বাসা পরিবর্তন করেননি এবং জীবিকার তাগিদে ঢাকায় নতুন মানুষও তেমন একটা আসেননি।

‘এছাড়া ঠিক মতো বেতন না পাওয়া, কাজ না থাকা, এমনকি চাকরি হারানো’— এসব কারণে ঢাকা ছাড়ছেন মানুষ। তিনি আরও বলেন, ‘অনেকের ইনকাম কমে গেছে, যে কারণে আগে ১৬ হাজার টাকার বাসায় থাকলেও এখন ১০ হাজার টাকার বাসায় চলে যেতে চাচ্ছেন। অনেকে চাকরিচ্যুত হয়েছেন। অনেক ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী আছেন, যাদের ব্যবসা একেবারেই বন্ধ, তারা পরিবার নিয়ে গ্রামে চলে গেছেন।’

ভাড়াটিয়া সংকটে নিজের বিপদের কথা কাছে জানান মিরপুরের শেওড়াপাড়ার বাড়ির মালিক নাসির উদ্দিন। বলেন, প্রায় বাসাতেই ‘টু লেট’ ঝুলছে। কিন্তু ভাড়াটিয়া খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। ফলে বাড়ির মালিকদের আয়ের পরিমাণ কমে যাচ্ছে। আমিসহ অনেকেই বাসা ভাড়া কমিয়ে দিয়েছি। তবুও ভাড়াটিয়া পাচ্ছি না। ভাড়াটিয়া না থাকলেও নিয়মিত ওইসব ফ্ল্যাটের মাসিক গ্যাস বিল, বিদ্যুৎ বিল, পানির বিল পরিশোধ করতে হচ্ছে। সবমিলিয়ে এক ধরনের সংকটে পড়ে গেছি।

এসব বিষয়ে ভাড়াটিয়া পরিষদের সভাপতি বাহরানে সুলতান বাহার বলেন, করোনা পরিস্থিতিতে অনেকেই কর্মহীন হয়ে পড়েছেন, অনেকেরই আয় কমেছে। এই অবস্থায় বাসা ভাড়া পরিশোধ করা কঠিন হয়ে পড়েছে। এমন পরিস্থিতিতেও বাড়ি মালিকরা কোনো ভাড়াটিয়ার পাশে দাঁড়াননি। ভাড়া মওকুফ করেননি অল্প পরিমাণও। তাই বাধ্য হয়ে অনেক ভাড়াটিয়া ঢাকা ছেড়ে গ্রামে চলে গেছেন।

তিনি বলেন, আমরা প্রথম থেকেই দাবি জানিয়ে আসছি, নিম্ন-মধ্য আয়ের মানুষের জন্য কিছুটা হলেও বাড়ি ভাড়া মওকুফ করা হোক। কিন্তু আমাদের কথা কেউ শোনেনি। ভাড়া কিছুটা মওকুফ করলেও অনেকে ঢাকায় থাকতে পারতেন।

ঢাকাসহ সারাদেশের বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার দুই হাজার ৩৭১ জনের সাক্ষাৎকার নিয়ে বেসরকারি সংস্থা ব্র্যাক মে মাসে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে। এতে দেখা যায়, ৩৬ শতাংশ লোক চাকরি বা কাজের সুযোগ হারিয়েছেন। ৩ শতাংশ লোকের চাকরি থাকলেও বেতন পাননি। আর দৈনিক মজুরিভিত্তিতে যারা কাজ করেন, তাদের ৬২ শতাংশই কাজের সুযোগ হারিয়েছেন। করোনার কারণে ১০টি জেলার মানুষের আয় কমে গেছে। ঢাকা জেলার মানুষের আয় কমেছে ৬০ শতাংশ।

পরিসংখ্যান থেকে জানা গেছে, রাজধানীর বাসিন্দাদের ৮০ শতাংশই ভাড়া বাসায় বসবাস করেন। যাদের মধ্যে অনেকেই এখন হারিয়েছেন চাকরি বা উপার্জনের পথ।

ভোক্তা অধিকার নিয়ে কাজ করা সংগঠন কনজ্যুমার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) এক হিসাবে দেখা যায়, গত ২৫ বছরে রাজধানীতে বাড়ি ভাড়া বেড়েছে প্রায় ৪০০ শতাংশ। একই সময়ে নিত্যপণ্যের দাম বেড়েছে ২০০ শতাংশ। অর্থাৎ এ সময়ে নিত্যপণ্যের দামের তুলনায় বাড়ি ভাড়া বৃদ্ধির হার প্রায় দ্বিগুণ। সংগঠনটির অন্য এক হিসাব বলছে, ঢাকার ২৭ শতাংশ ভাড়াটিয়া আয়ের প্রায় ৩০ শতাংশ, ৫৭ শতাংশ ভাড়াটিয়া প্রায় ৫০ শতাংশ, ১২ শতাংশ ভাড়াটিয়া আয়ের প্রায় ৭৫ শতাংশ টাকা ব্যয় করেন বাসা ভাড়ায়।

কিন্তু করোনার কারণে আয়ে যে ধাক্কা লেগেছে, সেটা সামলাতে না পেরে নগরে আসা লোকজনকে ফিরে যেতে হচ্ছে নিজ নিজ গ্রামে, নিজ নিজ শিকড়ে।  সূত্র : জাগো নিউজ

Leave A Reply

Your email address will not be published.