পাকিস্তানি মিডিয়ায় বাংলাদেশি মাদরাসা ছাত্রের যৌন নিপীড়নের বক্তব্য

392

ঢাকা: বাংলাদেশে মাদরাসার শিক্ষক ও সিনিয়র ছাত্রদের হাতে ক্রমাগত যৌন নিপীড়নের ঘটনা নিয়ে সোশাল মিডিয়ায় মুখ খুলছেন সাবেক শিক্ষার্থীরা। এমন এক না বলা স্পর্শকাতর বিষয় নিয়ে বাংলাদেশের মতো একটি রক্ষণশীল দেশে নীরবতা থেকে বের হয়ে আসছেন তারা। এমনইটাই বলা হয়েছে পাকিস্তানের শীর্ষস্থানীয় সংবাদপত্র ‘দ্য ডন’ এর এক প্রতিবেদনে। সেখানে তুলে আনা হয়েছে মাদরাসা থেকে পড়ে আসা এক শিক্ষার্থীর কথা যিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সাংবাদিকতা নিয়ে পড়াশোনা করছেন। তিনি নিয়মিত মাদরাসায় ধর্ষণ ও যৌন নির্যাতন বিষয়ে লেখালেখি করেন। 

ওই প্রতিবেদনে বলা হয়, মাদরাসা শিক্ষার্থীদের যৌন নিপীড়নের বিষয়টি বরাবরই আলোচনার বাইরের বিষয় ছিল। এক মাদরাসার প্রধান শিক্ষকের বিরুদ্ধে যৌন নির্যাতনের অভিযোগ আনার পর গত এপ্রিলে ওই মাদরাসার ছাত্রীকে (ফেনীর সোনাগাজীতে নুসরাত জাহান রাফিকে পুড়িয়ে মারার ঘটনা) আগুনে পুড়িয়ে নিষ্ঠুরভাবে হত্যার পর বিষয়টি প্রবলভাবে উঠে আসে। এ ধরনের ঘটনা জাতীয় নিরাপত্তার সঙ্গে জড়িত এবং সংশ্লিষ্ট বিষয়ে প্রথমবারের মতো বিতর্কের সৃষ্টি হয়। কেবল জুলাইয়েই কমপক্ষে ৫ জন মাদরাসার শিক্ষককে গ্রেপ্তার করা হয়েছে ছেলে ও মেয়ে শিক্ষার্থীকে যৌন নিপীড়নের অভিযোগে। এক ১১ বছর বয়সী অনাথকে ধর্ষণের পর শিরশ্ছেদের ঘটনায় মাদরাসার বেশ কয়েকজন সিনিয়র শিক্ষার্থীকেও গ্রেপ্তার করা হয়। এ ছাড়া ১২-১৯ বছর বয়সী ডজনখানেক বালককে যৌন নির্যাতনের অভিযোগ উঠেছে একজন ইমাম ও শিক্ষকের বিরুদ্ধে। 

এসব চিত্র গ্রামের দরিদ্র পরিবার থেকে আসা শিক্ষার্থীদের যৌন নিপীড়নের শিকার হওয়ার ঘটনা প্রকাশ করে যাদের বাবা-মায়ের সন্তানকে সাধারণ স্কুলে পড়ানোর সাধ্য নেই, বলা হয় প্রতিবেদনে। 

প্রতিবেদনে সাবেক মাদরাসা ছাত্র ও বর্তমানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সাংবাদিকতা বিভাগে অধ্যয়নরত শিক্ষার্থী মীর হুযাইফা আল-মামদূহ কথা বলা হয়েছে। তিনি রাজধানী ঢাকার তিনটি মাদরাসায় লেখাপড়া করেছেন। জুলাইয়ে নিজের ফেসবুকে ধারাবাহিকভাবে মাদরাসার মতো শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে যৌন নির্যাতনের ঘটনা নিয়ে লিখেছেন। সেখানে নিজের অভিজ্ঞতার কথাও লিখেছেন। 

জুলাইয়ের ১৫ তারিখে তিনি এক ফেসবুক পোস্টে লিখেছেন যে, মাদরাসায় শিশু ধর্ষণ নিয়ে তিনি আর লেখবেন না। এর পর থেকে তার প্রোফাইলে সংশ্লিষ্ট বিষয়ে আরো কোনো লেখা পাওয়া যায়নি। এখানে তার সেই স্ট্যাটাসটি হুবহু তুলে ধরা হলো- 

মাদরাসার শিশু ধর্ষণ নিয়ে আমি আর লিখছি না। এই বিষয়টা নিয়ে আমার এটাই সম্ভবত শেষ পোস্ট।
লিখছি না, কারণ, আমাদের দেশে বলবার অধিকার নেই। কেউ কিছু নিয়ে বলতে শুরু করলে আর সে যে কোন প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে গেলেই যিনি বলবেন, তার বিরুদ্ধে অলিখিত হুলিয়া জারি হয়। তার মৃত্যুনামা; পরওয়ানা লিখে দেন অনেকেই।

আর বিশেষ করে ধর্ম কেন্দ্রীক কিছু হলে তো কথাই নেই। (যদিও মাদরাসা কখনই ধর্ম নয়। লোকে এটাকে ধর্ম বলে ভেবে নিচ্ছে, যেটা অপরাধ)

আমি এই লেখা শুরু করবার পর থেকেই অনেক মানুষ আমাকে সেইফে থাকতে বলেছেন, যেন আমি কোন ব্লাসফেমি করে ফেলেছি। (ব্লাসফেমি, মানে ধর্মের বিপক্ষে বলতে পারা নিয়েও আমার তর্ক আছে। এবং আমি প্রচণ্ড মুসলমান)

আমার মা-ও এই ব্যাপারটা জেনেছেন, মানে আমার এই কাজ, এইসব নিয়ে কথা বলা। তারপর আমার কারণ জানবার পর তিনি আমাকে কাজ করবার জন্যেই বলেছিলেন। উৎসাহ দিয়েছেন।

এরপর এই ব্যাপারটা আমাদের পরিবারে একটু ঘোলাটে হয়ে যাওয়াতে, আমার এক মামা তাকে-আমাকে কেউ মেরে ফেলবার ভয় দেখান। আর তারপর থেকেই আম্মুর দিনমানের একমাত্র চিন্তা আমার বেঁচে থাকা। সারাক্ষণের এসব চিন্তার রেশ আমার উপর দিচ্ছেন। আমি নিতে পারছি না, সেসব। আমি তাই আর এইসব পোস্ট, মানুষের ঘটনার জানান, আর দেব না।

হ্যাঁ, হয়ত বেঁচে থাকাটা আমার জন্যেও জরুরি। তবে আগের পোস্টগুলো থাকবে ওয়ালে। চাইলে আপনারা শেয়ার করতে পারবেন। মানুষকে জানান দিতে পারবেন।

এবার কিছু উত্তর দেই…

আমি কেন নেমেছিলাম এই বিষয়ে
আমি নেমেছিলাম, কারণ, এই মাদরাসাগুলোতে যেসব হয়, বাচ্চাদের সাথে সেটা ধর্ষণ। একটা ছেলে, যে এই ধর্ষণের শিকার হয়েছে, সে তার জীবনে এই কালিমাটা বয়ে চলে মৃত্যু অবধি। তার ভেতরকার এই গ্লানি তাকে কুরে কুরে খায়। কখনো এমন কোনও ছেলের সাথে খুব আপন করে দেখেন, বলবে।

আমি চেয়েছি, এই ব্যাপারটা দূর হোক। একটা মানুষ একটা গ্লানিমুক্ত শৈশব পাক। সে বড় হয়ে তার ছোটবেলাকার কোন মুহূর্তকে মুছে ফেলতে না চাক। একটা মানুষ অনেক বেশি দামি, তার হৃদয়।

একটা ফার্সি কবির শে’র আমাদের পড়িয়েছিলেন হুজুর, ‘কা’ বা বানিয়েছে, আজরের পুত্র ইবরাহিম, আর হৃদয় বানিয়েছেন, মহাপরাক্রমশালী সত্ত্বা। আমি সেই হৃদয়ের শুদ্ধতাকে চেয়েছি।

মাদরাসায় কি আসলেই এতটা ভয়াবহ আকারে, যতটা আমি বলছি?
একটা টাস্ক দেই আপনাদের। নিজেরাই বুঝে যাবেন।

গবেষণার উপাত্ত সংগ্রহের একটা কৌশল হচ্ছে, র‍্যান্ডম স্যামপ্লিং, মানে যা পাবে, তা থেকেই বিবেচনা করা হয়। আমি সেই রকম একটা উপায় শিখিয়ে দেই।

আজ থেকে আপনার চোখে প্রথম যে ৫ জন মাদরাসা ছাত্র পড়বে, তাকে বেশ ঘনিষ্ঠ হয়ে জিগেস করবেন, সময় নিয়ে, আপন করে, যাতে সে আপনার সাথে শেয়ার করতে আরাম পায়। দেখবেন, এর মধ্যে অন্তত কেউ এই রকম ধর্ষণের শিকার, এইটুকু শিকার না করলে অন্তত তার খুব পরিচিত কেউ এসবের শিকার হয়েছেন, বলবে। আর পরিচিতর কথা বলবে এই ৫ জনের সবাই-ই।
আর এটাই আপনাকে বলে দেবে, কতটা ব্যাপক।

আরো কোথাও কি এমন হয় না? কেন মাদরাসা নিয়ে? আমি আরো কোথাও হয় কি না, তা আমি জানি না, শুনেছি।

আর আমি এই যতগুলো পোস্ট দিলাম, শোনা কোন ঘটনা দেই নাই। দেখা ঘটনা দিয়েছি। নিজের সাথে ঘটা ব্যাপারগুলো নিয়ে বলেছে ভিক্টিম। আর মাদরাসায় পড়া হয়েছে, বলে আমিও এই ব্যাপারগুলোর ভেতর দিয়ে গেছি। দেখেছি।

মাদরাসার জন্যে কি আমার কোন বিদ্বেষ আছে কী না
না, মাদরাসার প্রতি আমার কোনো বিদ্বেষ নেই। আমি যেহেতু মাদরাসায় ২০ বছর পড়েছি। তাই মাদরাসার জন্যে আমার একটা অধিকার আছে বলেই আমি মনে করি।

আর হ্যাঁ, আমি ধর্মকে প্রতিষ্ঠানীকরণের বিরোধী। ধর্মের উপর কারুর একচ্ছত্র অধিকার নেই। যখন কেউ এই অধিকারের দাবি করে, তখন-ই ধর্মের নাশ হয়। ১৬ শ শতকের চার্চগুলো যেমন খৃষ্টধর্মের ক্ষতি করেছিল। পুরোহিত তন্ত্র যেমন হিন্দু ধর্মের ক্ষতি করছে।

ধর্ম সব মানুষের, সবার অধিকার আছে এর উপর। হ্যাঁ, স্কলাররা ধর্মের নির্দেশনা দেবেন, তবে ধর্ম দিয়ে খবরদারি করবেন না, কারুর উপর।

আমার মনে হচ্ছে, এইসব মাদরাসাগুলো, মসজিদের ইমামেরা ধর্মের অথরিটি নিয়ে খবরদারি টাইপ একটা জায়গায় চলে গেছে। আমি তাই মাদরাসা নিয়ে বলছি, যাতে এই অথরিটি না গড়ে ওঠে। গড়ে উঠলেই ধর্মের বিনাশ। আমি তাই ধর্মের জন্যেই বলছি।

দেখবেন, এই অথরিটি এখন এমন একটা প্রতিষ্ঠানের রূপ নিয়েছে, যেন সেটা নিজেই ধর্ম হয়ে গেছে। আর এর পড়ুয়ারা ধর্মের ধারক, কিংবা একমাত্র রক্ষাকর্তা।

এঁদের বিপক্ষে বলাটাই ধর্মের বিপক্ষে বলা হয়ে গেছে। আমি তাই ধর্ম বাঁচাতেই মাদরাসার ধর্ম হয়ে ওঠার বিপক্ষে বলেছি।

স্কুল কলেজের পাপ নিয়ে বলার ব্যাপারে…
হাক্কুল ইবাদের পোস্ট পড়েন, ক্লিয়ার হবে। আরো একটু বলি, মাদরাসার বাইরে এত ম্যাসিভ আকারে ছেলেরা আর কোথাও ধর্ষিত হয় বলে আমার জানা নাই। আমি সব পাপ নিয়ে তাই না বলে এই পাপ, যা একটা মানুষের সময়গুলোকে বিষাক্ত করে দেয়, তার বিপক্ষে বলেছি।

এখন হয়ত থেমেছি বিভিন্ন কারণে। কিন্তু আমি থামছি না, আমি বলব। বলেই যাব। আপনারা থামবেন না, নিজেদের মত করে কথা বলে যাবেন। প্রতিবাদ করবেন।

আমার এই পোস্টে লাভ হয়েছে কী না, কমবে কী না?
লাভ হয়েছে কী না জানি না। তবে যতজন এই পোস্ট পড়েছেন, সবাই অন্তত নিজেদের আত্মীয়দের ক্ষেত্রে মনোযোগী হবেন বলেই আশা করি। এই মনোযোগটাই আসলে জরুরি।

এই তো। ভালো থাকবেন।
আর হ্যাঁ, আপনাদের গল্প শেয়ার করতে থাকেন আমার সাথে। হয়ত কখনও বিস্ফোরণ ঘটবে। বিস্ফোরণ ছাড়া কখনও কোনো পরিবর্তন আসেনি।

ডনের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, মাদরাসার শিক্ষকরা শক্তভাবে এসব অভিযোগ প্রত্যাখান করেছেন। এসব অভিযোগকে ‘নেতিবাচক প্রপাগান্ডা’ বলে অভিহিত করেছেন। ঢাকা মোহাম্মদপুরের এক মাদরাসার প্রধান শিক্ষক মাহফুজুল হক এএফপি’কে বলেন, একটি বা দুটি বিচ্ছিন্ন ঘটনা ঘটতে পারে। দক্ষিণ এশিয়ার এই দেশটিতে ২০ হাজার মাদরাসা রয়েছে। 

যারা মাদরাসায় পড়তে পছন্দ করে না তারা এসব গল্প ছড়ায়, যোগ করেন তিনি। 

হেফাজতে ইসলামের এক মুখপাত্রের বরাত দিয়ে প্রতিবেদনে বলা হয়, হাজারো মাদরাসার সমন্বয়কারী এই সংস্থা সম্প্রতি এক সম্মেলনে ১২০০ অধ্যক্ষকে ‘যৌন অপরাধের বিরুদ্ধে শক্ত অবস্থান’ নেওয়ার কথা বলা হয়। 

প্রো-ইসলামিক ওয়েবসাইট ফাতেহ টুয়েন্টিফোর ডট কম এর এক রিপোর্টের কথা তুলে ধরা হয় প্রতিবেদনে। বলা হয়, ছোট ছোট ধর্মীয় শিক্ষলয়গুলো যেখানে কেবল একজন বা দুজন শিক্ষক কাজ করেন, সেখানে সরকারের কোনো নজরদারি নেই। 

এক সাবেক মাদরাসা শিক্ষার্থী এবং শিক্ষক ইফতেখার জামিল জানান, এই ঘটনাগুলো ‘বিচ্ছিন্ন নয়’ এবং তিনি মাদরাসায় শিক্ষার্থীদের ঘুমানোর স্থানে ক্লোজড-সার্কিট ক্যামেরা বসানোর পরামর্শ দেন। 

সূত্র: দ্য ডন

Leave A Reply

Your email address will not be published.