যুক্তরাষ্ট্রে ২০০ মিলিয়ন ডলার আত্মসাতের নেপথ্যে বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত মাশিয়াত

317

মিশিগান (যুক্তরাষ্ট্র) থেকে: ভুয়া চিকিৎসা এবং থেরাপি প্রদানের বিল করে ২০০ মিলিয়ন ডলার হাতিয়ে নেয়ার মামলায় আমেরিকার মিশিগানের বাংলাদেশি মাশিয়াত রশিদ, আব্দুল হক এবং মোহাম্মদ জহুরসহ বেশ কয়েকজনের বিচার শুরু হয়েছে। এরা সংঘবদ্ধভাবে মিশিগান এবং ওহাইয়ো এলাকায় সাইনবোর্ড সর্বস্ব ক্লিনিক, ল্যাবরেটরি, থেরাপি সেন্টার, হোমকেয়ার ইত্যাদি চালু করে ভুয়া বিল সাবমিট করেন মেডিকেয়ারের কাছে। এমন অনৈতিক ও প্রতারণামূলক কাজে বেশ কিছু দালাল/এজেন্ট নিয়োগ করা হয় মক্কেল আনার জন্য। এ সংঘবদ্ধ প্রকল্পে লোভী চিকিৎসকরাও অংশ নেন। অর্থাৎ সুপরিকল্পিতভাবে চিকিৎসা ও স্বাস্থ্যসেবার প্রেসক্রিপশন তৈরি ও চিহ্নিত ফার্মেসি থেকে ওষুধ প্রদানের মহড়া, থেরাপি সেন্টারের নামে স্বাস্থ্যসেবা, হোমকেয়ারের বিলও করা হয়।

মামলার বিবরণে আরও প্রকাশ,‘ ট্রাই-কাউন্টি ওয়েলনেস’ নামক একটি প্রতিষ্ঠানের নামে ভুয়া বিল করা হয়েছে। আর এই প্রতিষ্ঠানের সিইও, মালিক, পরিচালক হচ্ছেন মাশিয়াত রশিদ (৩৭)। ৩ বছর বয়সে মা-বাবার সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রে আসা মাশিয়াত উচ্চ শিক্ষা গ্রহণের পর এই প্রতারণার ফাঁদ পাতেন স্বাস্থ্যসেবার নামে। মামলার তদন্তে আরও উদ্ঘাটিত হয়েছে যে, মাশিয়াত লোভে এতটাই বেপরোয়া হয়ে পড়েন যে দালালদের নগদ অর্থ প্রদানের জন্য একইসঙ্গে ৫ লাখ ডলার ড্র করেন ব্যাংক থেকে। এ অর্থের বস্তাও তার বাসার ক্লোজেট থেকে উদ্ধার করা হয়েছে। এ সময় তারা মাশিয়াতের এমন কয়েকটি বাড়ি ও গাড়ির হদিস পান, যা চমকে দেয়ার মত। কয়েক বছর আগে যিনি ব্যাংক্রাপসী করেছিলেন, সেই যুবক কীভাবে এত বিপুল অর্থ সম্পদের মালিক হলেন সেটিও কর্তৃপক্ষের কৌতূহলের অন্যতম বিষয় ছিল। গত বছর তিনি অবশ্য ৪ মিলিয়ন ডলারের ট্যাক্স রিটার্নও দিয়েছেন। সাম্প্রতিক সময়ে মাশিয়াত তার বিভিন্ন ল্যাবরেটরি, ক্লিনিক, হোমকেয়ার সার্ভিস স্টেশন পরিদর্শন করতেন নিজস্ব বিমানে। আলাউদ্দিনের চেরাগ হাতে পাওয়া মাশিয়াত খুব কম সময়েই কম্যুনিটির লোকজনের সঙ্গে কথা বলতেন। চলাফেরায় অতি মডার্ন ভাব ছিল। দামি ঘড়ি পরতেন পোশাক আর অনুষ্ঠানের মেজাজের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে।

মামলার বিবরণে আরও জানা গেছে, ৩১ জুলাই বিচার শুরুর পর আদালত জানতে পেরেছেন ৪২ লাখ ভুয়া প্রেসক্রিপশন ইস্যু করা হয় মিশিগানের ওয়েস্ট ব্ল–মফিল্ডের বাসিন্দা মাশিয়াতের প্রতারণার ফাঁদে। তার সহযোগিদের অন্যতম হচ্ছেন একই এলাকার তারেক ওমর(৬১), নভির মোহাম্মদ জহুর (৫১), ওহাইয়োর মনক্লোভার স্পিলিয়স পাপাস (৬১), নভির যোসেফ ব্রেট্রো (৫৭), ওকল্যান্ড কাউন্টির ইয়াসির মজিব (৩৫), ইপসিলেন্টির আব্দুল হক (৭২), তোসাদ্দেক আলী আহমেদ। মামলার তদন্ত করেছে এফবিআই, আইআরএস, স্বাস্থ্য বিভাগীয় কমিশনার। মিশিগানের ইস্টার্ন ডিস্ট্রিক্ট কোর্টের জজ ডেনিস পেইজ হুডের এজলাসে চলছে এই মামলা।

চাঞ্চল্যকর এবং এ যাবৎকালের বৃহত্তম এই হেল্থকেয়ার প্রতারণা মামলা প্রসঙ্গে অ্যাটর্নি জেনারেল বলেছেন, আমেরিকার ইতিহাসে যখন ওষুধ সংকট ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে, ঠিক তেমনি সময়ে কিছু চিকিৎসক ও করপোরেশনের মালিক আমাদের স্বাস্থ্যসেবার প্রকল্পের সঙ্গে প্রতারণার ফাঁদ পেতেছিল। তারা অসহায় আমেরিকানদের চিকিৎসা-সেবার সঙ্গে বড় ধরনের ধাপ্পাবাজি করেছে, যা কঠোর শাস্তির যোগ্য। আমেরিকার ট্যাক্স প্রদানকারীদের সঙ্গে এমন জঘন্য আচরণের সমুচিত শাস্তি সংশ্লিষ্টদের পাওয়াই উচিত। ২০০৮ সাল থেকে গত বছর ৬ জুলাই পর্যন্ত সময়ে মিশিগান ও ওহাইয়ো অঙ্গরাজ্যব্যাপী এমন অপতৎরতা পরিচালনা করা হয় নিজেদের আখের গুছিয়ে নেওয়ার অভিপ্রায়ে। মাশিয়াতের এই চক্রের চিকিৎসকরা মোটা ভাগা পেয়েছেন।

তদন্তে আরও উদ্ঘাটিত হয় যে, ইস্যুকৃত প্রেসক্রিপশনের ১০০% ছিল সংশ্লিষ্ট রোগীর জন্য একেবারেই অপ্রয়োজনীয় অর্থাৎ উদ্দেশ্যমূলকভাবে সে সব ইস্যু করা হয় কালোবাজারে পাচারের উদ্দেশ্যে অথবা ফার্মেসির সঙ্গে অর্থ ভাগাভাগির মতলবে। আরও জানা গেছে, এর আগেও মাশিয়াতসহ এই চক্রের কয়েকজনকে পুলিশ গ্রেফতার করেছিল। কিন্তু সে সময় যথাযথভাবে তদন্ত করতে না পারায় অথবা আইনের ফাঁক দিয়ে সবাই মুক্তিলাভ করেছিল। পরবর্তীতে সরেজমিনে ব্যাপক উদ্যোগে তদন্তের পর সবকিছু প্রকাশ পায়।

মাশিয়াতের প্রতারণা নেটওয়ার্কে ছিল দ্য ট্রাই-কাউন্টি নেটওয়ার্ক ফিজিশিয়ান বিজনেস, গ্লোবাল কোয়ালিটি ইনক, আকুয়া থেরাপি এবং পেইন ম্যানেজমেন্ট ইনক, ট্রাই কাউন্টি ফিজিশিয়ান গ্রুপ, ট্রাই-স্টেট ফিজিশিয়ান গ্রুপ, নিউ সেন্টার মেডিকেল, ট্রাই-কাউন্টি নেটওয়ার্ক ল্যাবরেটরিজ, ট্রাই-কাউন্টি নেটওয়ার্ক ম্যানেজমেন্ট থেরাপি এ্যান্ড হেলথকেয়ার ম্যানেজমেন্ট কোম্পানি ইত্যাদি।

Leave A Reply

Your email address will not be published.