সেই ভয়ঙ্কর রাতের বিস্তারিত বর্ণনা দিলেন ইউএনও ওয়াহিদার বাবা

171

ঢাকা: দিনাজপুর ঘোড়াঘাটের ইউএনও ওয়াহিদা খানমের আলমিরা থেকে কিছু একটা নিয়ে গেছে হামলাকারী দুর্বৃত্তরা। ঘটনার সময় চাবি না দিলে তার চার বছরের শিশু ছেলেকে হত্যা করার হুমকিও দিয়েছিল ওই দুর্বৃত্ত। ঘরে একজনই ছিল দুর্বৃত্ত। যার পরনে ছিল শার্ট ও প্যান্ট, পিপিই নয়। বাথরুমের ভেন্টিলেটর দিয়ে বেরিয়ে যান তিনি। ঘরের ভেতরে ঘটে যাওয়া ওই সময়ের তথ্য জানিয়েছেন হামলায় গুরুতর আহত ইউএনওর বাবা মুক্তিযোদ্ধা ওমর শেখ।

গতকাল রোববার বেলা ১টায় রংপুর মেডিক্যাল কলেজ হাসাপাতালের ১৯ নম্বর সার্জারি ওয়ার্ডের ভিআইপি ১ নম্বর কেবিনে চিকিৎসাধীন বীরমুক্তিযোদ্ধা ওমর শেখ বলেন সে রাতের ঘটনার কথা। এ সময় ওয়াহিদা খানমের মা রমিছা বেগম, বড় ভাই ও মামলার বাদি বগুড়ার কাহালু থানার পরিদর্শক শেখ ফরিদ উদ্দিনসহ স্বজনরা উপস্থিত ছিলেন।

রংপুর মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতলের পরিচালক ডা: ফরিদ উদ্দিন চৌধুরী জানিয়েছেন, ইউএনও ওয়াহিদা খানমের বাবা এখন অনেকটা সুস্থ। তিনি কথা বলতে পারছেন। নিজ হাতে খেতে পারছেন। তবে তার কোমরের নিচ থেকে এখনো অবশ আছে। তার চিকিৎসাপত্র ঢাকায় পাঠানো হয়েছে। সেখান থেকে তাকে রেফার্ড করার কথা বলা হলে তাকে এই হাসপাতাল থেকে ঢাকায় স্থানান্তর করা হবে। পুরো বিষয়টি তার পরিবার দেখভাল করছে। ইউএনও ওয়াহিদা খানমের বাবা মুক্তিযোদ্ধা ওমর শেখ ৭ নম্বর সেক্টরে কর্নেল নুরুজ্জামানের অধীনে সম্মুখযুদ্ধে অংশ নিয়েছেন।

তিনি বলেন, আমি প্রতিদিনই রাত সাড়ে ৪টার দিকে তাহাজ্জুদের নামাজ পড়ার জন্য উঠি। এরপর নাতিকে ফিডার খাওয়াই। কারণ নাতি বুকের দুধ পায় না। সে দিনও হয়তো আমার মেয়ে ফিডার বানিয়েছিল। ভাবলাম একটু শুই। তাহাজ্জুদ পড়ার পর খাওয়াবো। চোখেও ঘুম ধরে এসেছে। সাড়ে ৩টা মতো বাজে তখন। আমি বিছানায় গা এলিয়ে দিলাম। ভাবলাম একটু ঘুম হওয়ার পর উঠে তাহাজ্জুদ পড়ব।

হঠাৎ করে মেয়েটা চিৎকার দিয়ে উঠে বলল, বাবা দেখেন তো কোন বেয়াদব ঘরের ভেতর ঢুকছে। আমি আশ্চর্য হইছি। ঘরের ভেতরে ঢুকতে তো পারবে না। কারণ সব চাবি আমার কাছে আছে। কারণ ৫টা গেট ভেঙে কেউ কি আসতে পারে। আমি চোখে ঘুম থাকা অবস্থাতেই উঠে গেলাম ওর রুমে। দরজা সব সময় খোলা থাকে আমাদের। আমি ঘরে ঢোকামাত্রই আমাকে সঙ্গে সঙ্গে ধাক্কা মেরেছে বদমাইশ। আমি তখন ওকে ধাক্কা মারছি, ঘুষাঘুষি করছি। একপর্যায়ে সে আমারে ঘাড়ে হাতুড়ি দিয়ে আঘাত করে এবং শরীরের বিভিন্ন অংশে বাড়ি মেরে ফ্যাকচার করে ফেলে। আমি তবুও প্রটেকশন দিয়ে গেছি। আবারো বারি মারার পর আমি স্টিলের আলমিরাটার কাছে গিয়ে পড়ে গেছি। তবে তখন আমার সেন্স ছিল।

ওমর শেখ জানান, অনেকক্ষণ পর সে আমাকে বলে, এই সরে আয় ওখান থেকে। তখন আমি বলি বাবা আমার সরার বুদ্ধি নেই। তখন হাত ধরে হারামির বাচ্চাটা আমাকে টেনে নিয়ে এগিয়ে গেল। নিয়ে গিয়ে ল্যাট্রিনের দিকে আমার মুখ করে আলনা থেকে দু’টি কাপড় নামিয়ে আমাকে ছুড়ে দিয়ে বলল, এই মুখ ঢাক। আমি তখন ওর কথামতো মুখ ঢাকলাম। আমার নাতিটা তখন সারা মেঝেতে ঘুরে বেড়াচ্ছে। চার বছর বয়স ওর। এ দিকে বদমাইশটা বলছে, এই চাবি দে। চাবি দে। তখন আমি বললাম, বাবা চাবি কোথায় আছে আমি তো জানি না। জামাই-বেটির ঘর আমি কী করে জানব।

তখন সে আমাকে বলে, চাবি না দিলে তোর নাতিকে মেরে দেবো। তখন আমি তাকে বললাম। আরে বাবা ওকে মারলে কি চাবি পাবা। আমি কি চাবির কথা বলতে পারব। তখন ও বদমাইশটা সুইচ দিলো এবং ওয়ারড্রবের ওপরে থাকা ওর দু’টি ব্যাগে হাতড়াতে লাগল। ইউএনও মানুষ। টাকা-পয়সা কত কী থাকে ওর ব্যাগে। ২০/২৫/৪০ হাজার টাকা অনেক সময় ওর ব্যাগে থেকেই যায়। ও কোনো দিন ব্যাগ ড্রয়ারের ভেতরে ঢুকায় না। অফিস থেকে নিয়ে আসে ওভাবেই রাখে। আবার ওভাবেই অফিসে যাওয়ার সময় নিয়ে যায়। এরই মধ্যে শুনি ভটভট শব্দ হচ্ছে। তখন মুখ ঢাকা অবস্থায় চোখ বের করে দেখি বদমাইশটা আলমিরা খুলছে। শব্দ শুনতে পাচ্ছি। ভটভট করতেছে। তবে চাবি খুলে ভেতর থেকে কিছু নিলো, কিছু পাইল কি পাইল না, সেটা ওই সময়ে বুঝতে পারি নাই। তবে আমার ধারণা কিছু একটা নিলো।

কিছুক্ষণ পরে ল্যাট্রিনের ভেন্টিলেটর দিয়ে বের হয়ে চলে গেল। ডান হাতে হাতুড়ি ছিল। একজন ছিল তখন ঘরে, গায়ে শার্ট প্যান্ট ছিল, লুঙ্গি কিংবা পিপিই ছিল না। তখন আমি দেখি আমার মেয়ে শুয়ে আছে খাটে। আমি তখন মেয়ের দিকে হাত বাড়িয়ে দিয়ে ডাকলাম মারে, মা। অনেকক্ষণ পর সে জবাব দিলো। তখন সে (ওয়াহিদা) বলল, আমাকে মেরে রেখে গেছে আব্বা। ঘাড়ে মেরেছে। বুকে মেরেছে। আমাকে মেরে ফেলেছে আব্বা। আব্বা আমি ঘাড় ফেরাতে পারতেছি না, কথা বলতে পারছি না। এই টুকুনই আমার মেয়ের সাথে শেষ কথা হয়েছে। আর কোনো কথা বলেনি সে।

ওরা হয়তো ভেবেছিল আমার মেয়ে মারা গেছে। সে কারণে তাকে বিছানায় ওরা শুয়েই রেখেছিল। কী কারণে আমার মেয়ের ওপর হামলা হলো সেটি অনুমানের ওপর কিছু বলতে পারব না।

Leave A Reply

Your email address will not be published.