স্তন ক্যান্সার : কী লক্ষণ দেখে বোঝা যাবে? কীভাবে সাবধান হবেন?

350

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার হিসেবে বাংলাদেশে প্রতি বছর ১৫ হাজারের বেশি মানুষ ব্রেস্ট ক্যান্সার বা স্তন ক্যান্সারে আক্রান্ত হচ্ছেন। এদের মধ্যে শতকরা ৯৮ শতাংশের বেশি নারী, তবে খুব অল্প সংখ্যক পুরুষও স্তন ক্যান্সারে আক্রান্ত হন। প্রতি বছর প্রায় সাড়ে সাত হাজার মানুষ এ রোগে মারা যান। খবর-বিবিসি বাংলার।

স্তন ক্যান্সার কি?
বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকেরা বলছেন বাংলাদেশে ক্যান্সার আক্রান্ত মানুষের সংখ্যা প্রতি বছর বাড়ছে। সেই সঙ্গে বাড়ছে স্তন ক্যান্সারে আক্রান্তের হারও।

চিকিৎসকেরা বলছেন, স্তনের কিছু কোষ অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে গেলে, ওই অনিয়মিত ও অতিরিক্ত কোষগুলো বিভাজনের মাধ্যমে টিউমার বা পিণ্ডে পরিণত হয়।

সেটি রক্তনালীর লসিকা (কোষ-রস) ও অন্যান্য মাধ্যমে শরীরের বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে পড়ে। এই ছড়িয়ে যাওয়ার প্রবণতাই ক্যান্সার।

কেমন লক্ষণ নিয়ে আসেন রোগীরা?
জাতীয় ক্যান্সার গবেষণা ইন্সটিটিউটের হিসাব অনুযায়ী দেশে প্রতি বছর দেড় লাখের বেশি মানুষ ক্যান্সারে আক্রান্ত হন।

বাংলাদেশে নারীরা যেসব ক্যান্সারে আক্রান্ত হন তার মধ্যে স্তন ক্যান্সার শীর্ষে রয়েছে।

সামাজিক রক্ষণশীলতার কারণে বাংলাদেশের নারীরা যেখানে প্রকাশ্যে স্তন শব্দটি উচ্চারণ পর্যন্ত করতে চান না, সেখানে শরীরে প্রাথমিক কোন লক্ষণ দেখা গেলেও তারা গোপন রাখেন সেসব, যে কারণে বেশিরভাগ রোগী চিকিৎসকের শরণাপন্ন হন একেবারে শেষ পর্যায়ে।

ঢাকা সেন্ট্রাল ইন্টারন্যাশনাল মেডিকেল কলেজের অধ্যাপক ডা. নাজনীন নাহার বলেন, স্তন ক্যান্সারে শুধু নারীরা নন, পুরুষেরাও আক্রান্ত হতে পারেন। তবে নারীদের ক্ষেত্রে ঝুঁকি বেশি থাকে।

তিনি বলেছেন, ‘যেহেতু বাংলাদেশে ব্রেস্ট ক্যান্সার নিয়ে সচেতনতার অভাব আছে, দেখা যায় যারা চিকিৎসা নিতে আসেন, তাদের বেশির ভাগই আসেন প্রায় শেষ পর্যায়ে।’

‘অধিকাংশ সময় তারা স্তনে একটি চাকা নিয়ে আসেন। অনেকে স্তনের বোঁটায় ঘা বা ক্ষত বা বোঁটার চারপাশে কালো অংশে চুলকানির লক্ষণ নিয়ে আসেন।’

‘কারো স্তনের বোঁটা দিয়ে দুধের মত সাদা রস নিঃসৃত হতে থাকে। ব্যথা বা স্তন লাল রং হয়ে গেছে এমন লক্ষণ নিয়ে খুব কমই আসেন।’

স্তন ক্যানসার কেন হয়?
অধ্যাপক নাজনীন নাহার বলছেন, বাংলাদেশে স্তন ক্যান্সারে আক্রান্ত মানুষের সংখ্যা বাড়ছে, তবে সেই সঙ্গে কিছুটা সচেতনতা বাড়ার কারণে এখন মানুষ চিকিৎসকের কাছেও আগের তুলনায় বেশি যায় এবং সেজন্য আমরা জানতেও পারি বেশি আগের চেয়ে।

তিনি বলছে, নানা কারণে স্তন ক্যান্সার হতে পারে।

‘আমাদের জীবনাচরণে এবং খাদ্যাভ্যাসে অনেক পরিবর্তন এসেছে, সেটি একটি কারণ। এছাড়া কারো পরিবারে স্তন ক্যানসারের ইতিহাস থাকলে হতে পারে। কারো যদি বারো বছরের আগে ঋতুস্রাব হয় এবং দেরিতে মেনোপজ বা ঋতু বন্ধ হয়, তারাও ঝুঁকিতে থাকে। সেই সঙ্গে তেজস্ক্রিয় স্তন ক্যানসারের ঝুঁকি বাড়ায়।’

অধ্যাপক নাজনীন নাহার বলেন, দেরিতে সন্তান গ্রহণ, আবার যাদের সন্তান নেই, বা সন্তানকে বুকের দুধ না খাওয়ানো, খাদ্যাভ্যাসে শাকসবজি বা ফলমূলের চাইতে চর্বি ও প্রাণীজ আমিষ বেশি থাকলে এবং প্রসেসড ফুড বেশি খেলে, এবং অতিরিক্ত ওজন যাদের তাদেরও স্তন ক্যান্সারের ঝুঁকি থাকে।

এছাড়া দীর্ঘদিন ধরে জন্ম নিয়ন্ত্রণ পিল খাচ্ছেন বা হরমোনের ইনজেকশন নিচ্ছেন, তারাও ঝুঁকির মধ্যে রয়েছেন।

একই সঙ্গে বয়স বাড়ার সাথে স্তন ক্যান্সারে আক্রান্ত হবার সম্ভাবনা বাড়ে। বিশেষ করে ৫০ বছর বয়সের পর এই ঝুঁকি অনেক বেশি বেড়ে যায়। তখন আর করার কিছু থাকে না।

তিনি বলছেন, প্রাথমিক অবস্থায় সনাক্ত হলে স্তন ক্যান্সার ১০০ ভাগ নিরাময়যোগ্য।

কখন চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে?
• স্তনে চাকা বা পিণ্ড দেখা দিলে

• স্তনের বোঁটার কোন ধরনের পরিবর্তন, যেমন ভেতরে ঢুকে গেলে, অসমান বা বাঁকা হয়ে গেলে

• স্তনের বোঁটা দিয়ে অস্বাভাবিক রস বের হলে

• স্তনের চামড়ার রং বা চেহারায় পরিবর্তন হলে

• বাহুমূলে পিণ্ড বা চাকা দেখা গেলে

তবে অধ্যাপক নাজনীন নাহার বলছেন, বয়স ৩০ বা ৩৫ হবার পর সব নারীর উচিত নিয়মিত নিজের স্তন পরীক্ষা করে দেখা। এজন্য মূলত তিনটি পদ্ধতি প্রচলিত আছে।

• ম্যামোগ্রাম বা বিশেষ ধরনের এক্স রে, যার সাহায্যে স্তনের অস্বাভাবিক পরিবর্তন ধরা পড়ে।

• সুনির্দিষ্ট নিয়মে চাকা বা পিণ্ড আছে কিনা, চিকিৎসকের মাধ্যমে সে পরীক্ষা করানো।

• নিজে নিজে নির্দিষ্ট নিয়মানুযায়ী স্তন পরীক্ষা করা।

বাংলাদেশে স্তন ক্যানসারের চিকিৎসা
বাংলাদেশে ক্যান্সার বিশেষায়িত চিকিৎসার জন্য হাসপাতাল আছে চারটি।

বাংলাদেশ ক্যান্সার ইন্সটিটিউটসহ সরকারি বেসরকারি অনেক হাসপাতালে স্তন ক্যানসারের চিকিৎসা চলছে।

তবে, কয়েকটি বেসরকারি ও কিছু বড় সরকারি হাসপাতালে একটি করে ক্যান্সার ইউনিট থাকলেও বাংলাদেশে ক্যান্সার বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের সংখ্যা দেড়শ’র কম।

অন্যদিকে, বাংলাদেশে ক্যান্সারের যেসব চিকিৎসা ব্যবস্থা আছে, তা একদিকে অপ্রতুল এবং অন্যদিকে দীর্ঘ মেয়াদে বেশ ব্যয়বহুল।

ফলে পরিবারে কারো ক্যান্সার হলে, সেটি ঐ পরিবারের ওপর এক ধরণের দুর্যোগ ডেকে আনে।

এ সময় পরিবার এবং বন্ধুবান্ধবসহ আশেপাশের মানুষের মানসিক সহায়তা একজন রোগীকে দ্রুত সেরে উঠতে সাহায্য করে, যা পাওযার সুযোগ নারীদের কম।

সরকারিভাবে স্তনের ক্যান্সার নির্ণয় ও নিরাময়ে রোগীর পরিস্থিতি ভেদে খরচ পঞ্চাশ হাজার টাকা থেকে দেড় লক্ষ টাকা।

বেসরকারি হাসপাতালে এ খরচ আরও বেশি।

তবে, অধ্যাপক নাহার বলেন, চিকিৎসা ব্যয় রোগীর শারীরিক অবস্থার ওপর নির্ভর করে। সেক্ষেত্রে প্রাথমিক অবস্থায় সনাক্ত হলে ব্যয় পরিকল্পনা করা যায়।

Leave A Reply

Your email address will not be published.